মাওলানা মাহমুদ হাসান হাসানি নদভি : নববী শিক্ষা মানুষকে শুধু সমীহযোগ্য মনুষ্যত্ব শিক্ষা দেয়নি, তার সব অধিকার আদায় করেনি; বরং তার শরীরের প্রতিটি অঙ্গ, অঙ্গের সুস্থতা ও অসুস্থতা, অনুভূতি ও সংবেদনশীলতা, স্বভাব ও প্রকৃতি; এমনকি তার মানসিক উদ্দীপনা ও প্রবণতার প্রতিও লক্ষ্য রেখেছে। সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য অপরিহার্য জিনিসগুলোর প্রতিও ইসলাম যত্নশীল। সামগ্রিক এই চিন্তা থেকেই ইসলাম মানুষের খাদ্য-পানীয় পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। যেন মানুষের রক্ত দূষিত না হয়। একইভাবে মানুষের নিত্যদিনের ব্যবহার্য জিনিসগুলো যেন পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন হয় সে নির্দেশ দিয়েছে। অর্থাৎ ক্ষতিকর জিনিস থেকে মানুষকে বিরত করেছে এবং মানুষের বৈধ ও আবশ্যক চাহিদা পূরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
ইসলাম মানবপ্রকৃতির রক্ষক : ইসলাম জীবনমুখী ধর্ম, একটি বিশেষ জীবন পদ্ধতি। ইসলাম মানব শরীরের অধিকার নষ্ট করতে চায় না; বরং তার প্রতিপালন, যত্ন, সংরক্ষণ ও সুস্থ বিকাশের তাগিদ দিয়েছে, উৎসাহিত করেছে। কোরআনের নির্দেশ হলো জীবনকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়ো না; খাও-পান করো তবে অপচয় কোরো না; বিয়ে করো, কেননা তাতে ভালোবাসা ও প্রশান্তি রয়েছে। এমনকি প্রাণী জবাইয়ের সময় সহানুভূতিশীল আচরণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিকৃত করতে নিষেধ করা হয়েছে। ইসলাম মানুষকে অঙ্গসজ্জা ও ফ্যাশন হিসেবে সেসব কাজ করতে নিষেধ করেছে শরীর ও মন, স্বভাব ও প্রকৃতিতে বিকৃতি আনে। যেমন—বিপরীত লিঙ্গের বেশ ধারণ করা। এতে মহান স্রষ্টা ও মনুষ্যত্ব উভয়ের প্রতি অসম্মান হয়।
শরীর আল্লাহর আমানত : হাদিসের ঘোষণা হলো, মানুষের শরীর তার আত্মার মতোই আল্লাহর আমানত। সুতরাং তা সংরক্ষণ করা এবং তার অধিকার আদায় করা ইবাদত। রাসুলুল্লাহ (সা.) উম্মতকে সতর্ক করে বলেছেন, তোমার ওপর অধিকার আছে তোমার শরীরের, তোমার চোখের, অন্য সব অঙ্গের, তোমার অতিথি, তোমার স্ত্রীর। সুতরাং তুমি নপুংসক হয়ো না, সন্ন্যাসী হয়ো না এবং তোমার জীবন রক্ষা করো।
পরিচ্ছন্ন জীবন মানুষের অধিকার : পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা মানুষের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবনের অধিকার। মানবজীবনে এর প্রভাব অপরিসীম। তবে উভয়টির মধ্যে পার্থক্য আছে। পরিচ্ছন্নতার সম্পর্ক বাহ্যিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে। মানবপ্রকৃতির স্বাভাবিক দাবি অনুসারে মানুষ যা করে। যেমন—গোসল করা, পরিষ্কার কাপড় পরিধান করা। এ বিষয়গুলো সব ধর্ম, সভ্যতা ও সভ্য মানুষ স্বীকৃতি দিয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেও পরিচ্ছন্নতাকে গুরুত্ব দিতেন। নিজের পরিবার ও সাহাবিদের উৎসাহিত করতেন। তিনি সুগন্ধি ব্যবহার করতেন, সাদা কাপড় পছন্দ করতেন, নিয়মিত মিসওয়াক ব্যবহার করতেন, নখ ছোট রাখতেন, চুল পরিষ্কার রাখতেন, তেল ও চিরুনি ব্যবহার করতেন। মহানবী (সা.) এত উচ্চ রুচি ও সূক্ষ্মানুভূতির অধিকারী ছিলেন যে তিনি প্রতিটি ভালো কাজ ডান হাতে ও ডান দিক থেকে করতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজের জন্য যা পছন্দ করতেন, তা তাঁর সব সাহাবির জন্য পছন্দ করতেন। সে হিসেবে তিনি পছন্দ করতেন যেন অন্যরাও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে।
সামাজিক জীবনে পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব : সামাজিক পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতে তিনি মসজিদ পরিচ্ছন্ন রাখার এবং মসজিদে আসার আগে মুসল্লিদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে আসার নির্দেশ দেন। আল্লামা ইবনে আবদু রব্বিহি (রহ.) ইমাম মালিক (রহ.)-এর সূত্রে লেখেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) মসজিদে ছিলেন। এক ব্যক্তি ধুলোমলিন ও উষ্কখুষ্ক চুল নিয়ে মসজিদে প্রবেশ করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে ইশারায় বের হয়ে যেতে বললেন। নির্দেশ দিলেন চুল ও দাঁড়ি ঠিক করতে। সে যখন পরিপাটি হয়ে মসজিদে প্রবেশ করল, তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, এমন নোংরা চুল নিয়ে থাকার চেয়ে শয়তানের কুৎসিত চেহারা কি উত্তম নয়?’ (আল-ইকদুল ফরিদ : ৭/২৫৩)
আলেমরা চুল ঠিক করে মসজিদে যাওয়ার উপকার বর্ণনায় বলেন, চুল-দাড়ি পরিপাটি থাকলে মুসল্লির নামাজে মনোযোগ রক্ষা করা সহজ হয়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে বনি আদম, প্রত্যেক নামাজের সময় তোমরা সুন্দর পরিচ্ছদ পরিধান করো।’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ৩১)। জুমার নামাজে অংশগ্রহণের আগে আরো বেশি পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কেননা জুমার নামাজে বেশি মানুষ অংশগ্রহণ করে।
পরিচ্ছন্নতার ঊর্ধ্বতর স্তর পবিত্রতা : পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ঊর্ধ্বতর স্তর পবিত্রতা, যার সঙ্গে শরীরিক স্বস্তি ও সুস্থতার সম্পর্ক সুগভীর। মানুষের চরিত্র ও স্বভাবের ভারসাম্য রক্ষায় ইসলাম পবিত্রতাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। পূর্ববর্তী কোনো বুজুর্গ আলেমের কাছে আত্মিক অস্থিরতার অভিযোগ করলে তারা পবিত্রতা রক্ষার কথা বলতেন। কেননা মানুষের ওপর প্রতিদিন শয়তান যে প্রভাব সৃষ্টি করে তা থেকে মুক্ত হওয়ার সর্বোত্তম মাধ্যম পবিত্রতা। অপবিত্রতার অবস্থা ঠিক তার বিপরীত। সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভি (রহ.) বলেন, ‘পবিত্রতা ইবরাহিম (আ.) ও মুহাম্মদ (সা.)-এর সভ্যতার (শরিয়তের) বৈশিষ্ট্য। ইসলাম এ ক্ষেত্রে যত বেশি সতর্ক, সচেতন ও অনুভূতিশীল (ঝবহংরঃরাব) এবং যত উঁচু মাপকাঠি দাঁড় করিয়েছে, অন্য কোনো ধর্ম ও সভ্যতায় তার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না। শরীর ও কাপড়ে যদি সামান্য পেশাব বা নাপাক বস্তু লেগে যায়, মুসলিমরা তা নিয়ে নামাজ আদায় করতে পারে না। চাই শরীর ও কাপড় যত ঝকঝকে-তকতকে হোক। একই বিধান প্রযোজ্য মুসলমানের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার্য খাবার, পানীয়, পাত্র, বিছানা, ভূমিসহ সব বস্তু ও উপকরণের। পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার এই সূক্ষ্মতম অনুভূতি শরিয়তে মুহাম্মদি ও ইবরাহিমি সভ্যতার বৈশিষ্ট্য।’ (আসরে হাজির কি চ্যালেঞ্জ, পৃষ্ঠা ১৮)
আল্লাহ সবাইকে পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র জীবন দান করুন। আমিন।
তামিরে হায়াত থেকে
মো. আবদুল মজিদ মোল্লার সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।