আন্তর্জাতিক ডেস্ক: আধুনিক যুগের অন্যতম দুই আসক্তির নাম মোবাইল ফোন ও টেলিভিশন। প্রযুক্তি খাতের এই দুটি উদ্ভাবন মানুষের জীবনকে যেমন সহজ করেছে, তেমনই মানুষের ওপর চরম আধিপত্যও বিস্তার করে চলেছে। কিন্তু এই দুটি প্রযুক্তি থেকে নিজেদের ‘মুক্ত বা স্বাধীন’ ঘোষণা করেছে ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের একটি গ্রাম! প্রতিদিন অন্তত কয়েক ঘন্টার জন্য পুরো গ্রাম চলে যায় ‘অফলাইনে’, অর্থাৎ ঐ সময়টায় গ্রামের কেউই টিভি বা মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারবেন না। বিবিসি-র প্রতিবেদক ইমরান কুরেশি-এর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বিস্তারিত।
মহারাষ্ট্রের সাংলি জেলার ভারগাঁও গ্রামে প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টায় একটি সাইরেন বেজে ওঠে এবং গ্রামেরা বাসিন্দারা তখন যার যার মোবাইল ও টিভি বন্ধ করে দেন। গ্রাম্য কাউন্সিল যখন সাড়ে আটটার দিকে আরেকটি সাইরেন বাজাবে, তখন চাইলে এই দুটি যন্ত্র ব্যবহার করা যাবে।
বিবিসি হিন্দিকে গ্রাম্য কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট বিজয় মোহিতে বলেন, “এবছর ১৪ আগস্ট, ভারতের স্বাধীনতা দিবসের আগেরদিন গ্রামের সবাই আলোচনা সভায় বসে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে এই দুটি আসক্তি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। পরদিন থেকে সাইরেন বাজার সাথেসাথেই ঘরে ঘরে মোবাইল-টিভি বন্ধ হয়ে যায়।”
ভাঁরগাও গ্রামের জনসংখ্যা প্রায় ৩০০০, বেশিরভাগ বাসিন্দাই মূলত কৃষক ও চিনিকলে কর্মরত শ্রমিকেরা।
বিজয় মোহিতে জানান, কোভিড-১৯ মহামারিকালে শিশুরা টিভি এবং অনলাইন ক্লাসের জন্য মোবাইল ফোনের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এবছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়ার পর বাচ্চারা আবার স্কুলে ফিরে যাচ্ছে।
“কিন্তু স্কুল থেকে ফিরেই তারা টিভির সামনে বসে যাচ্ছে বা মোবাইল ব্যবহার করছে। এমনকি প্রচুর প্রাপ্তবয়স্ক লোকজনও নিজেদের মধ্যে কথা বলার পরিবর্তে মোবাইলের পেছনে অনেক বেশি সময় ব্যয় করছে”, বলেন বিজয়।
গ্রামের বাসিন্দা বন্দনা মোহিতে জানান, তার দুই সন্তান মোবাইলে গেম খেলা ও টিভির প্রতি এত আসক্ত যে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু গ্রামে নতুন নিয়ম চালু হওয়ার পর থেকে তার স্বামীও কর্মক্ষেত্র থেকে ফিরে সন্তানদের লেখাপড়ায় সাহায্য করেন। ফলে বন্দনা নিজেও স্বস্তিতে রান্নাঘরের কাজ সেরে নিতে পারেন।
তবে ডিজিটাল দুনিয়ার অন্যতম আসক্তি থেকে সবাইকে দূরে রাখাটা সহজ ছিল না গ্রাম্য কাউন্সিলের জন্য। বিজয় মোহিতে জানান, কাউন্সিল যখন এই সমস্যাটি নিয়ে আলাপ করে এবং নতুন সিদ্ধান্তে আসে, তখন গ্রামের পুরুষেরা উপহাস করেছিল। তখন তারা গ্রামের সব নারীদের ডেকে আনেন এবং তাদের মতামত জানতে চান। নারীরা অকপটে স্বীকার করেন যে টিভি সিরিয়াল দেখা ও মোবাইলের পেছনে তাদের অনেকটা সময় ব্যয় হয়। গ্রামের নারীরা সবাই চান যে পুরো গ্রামে কয়েক ঘন্টার জন্য যেন টিভি-মোবাইল বন্ধ রাখার নিয়ম করা হয়।
এরপর আরেকটি সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে গ্রামের মন্দিরে ওপর সাইরেন লাগানো হবে এবং নির্দিষ্ট সময়ে তা বাজানো হবে। তবে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করাও সহজ ছিল না। সাইরেন বন্ধ হয়ে গেলেও কাউন্সিলের সদস্যরা বাড়ি বাড়ি টহল দিতেন এবং সবাইকে বলতেন মোবাইল-টিভি বন্ধ রাখতে।
বিজয় মোহিতে বলেন, “এখন আমাদের পুরো গ্রামেই এই নিয়ম বহাল রয়েছে।” কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, মোবাইল-টিভি বন্ধ করে রাখলেই কী সমস্যার সমাধান হবে?
ভারতের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড নিউরোসায়েন্সেস-এর ক্লিনিক্যাল সাইকোলজির অধ্যাপক ডা. মনোজ কুমার শর্মা ভাষ্যে, ‘এটা সম্ভব। কোভিড মানুষের মধ্যে অনলাইন কার্যক্রমকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রবণতা তৈরি করেছে।”
ডা. শর্মা ও তার সহকর্মীরা ২০২০ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ৬৮২ জন প্রাপ্তবয়স্ক নারী ও পুরুষের মধ্যে একটি গবেষণা পরিচালনা করেন, যেখানে দেখা যায় কিশোর-কিশোরী ও তরুণদের মধ্যে ‘ইন্টারনেট ব্যবহারজনিত সমস্যা’ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আধুনিককালে ইন্টারনেট ব্যবহারের ফলে যেসব জটিল সমস্যা তৈরি হয়েছে মানুষের মধ্যে, এটি তার তার মধ্যে অন্যতম।
গবেষণায় দেখা গেছে, কোনো কারণ ছাড়াই ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইন্টারনেট ব্যবহার করার ফলে সমস্যাগুলো তৈরি হয়, যা একজন মানুষের ওপর মানসিক চাপ তৈরি করতে পারে। এর ফলে বহু কিশোর-কিশোরীর ব্যক্তিগত জীবনে জটিলতা তৈরি হতে পারে।
কিশোর-কিশোরীরা মানসিক চাপ থেকে সাময়িক মুক্তি পেতে ইন্টারনেটকে বেছে নেয়। কিন্তু এর ফলে তারা সামাজিক মিথস্ক্রিয়া করতে ভুলে যায়, সামাজিক অনুষ্ঠান বা গেট টুগেদারে যোগ দেয় না, পারিবারিক আলোচনায় অংশগ্রহণ করে না এবং দিন দিন সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
তাই স্বেচ্ছায় ইন্টারেট থেকে দূরে থেকে নিজের পরিবারের সঙ্গে সময় কাটালে বা ইতিবাচক কাজ করলে ইন্টারনেটের উপর নির্ভরতা কমে, জানান ডা. শর্মা।
তিনি বলেন, “আপনাকে বাচ্চাদের সাথে কথা বলতে হবে, তাদের খাওয়া-ঘুম পর্যাপ্ত পরিমাণে হচ্ছে কিনা এবং অবসর সময় কাটানোর জন্য যথাযথ সুযোগ-সুবিধা আছে কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে।”
ভারগাঁও গ্রামের আখচাষী দিলীপ মোহিতের স্কুলগামী তিন ছেলে রয়েছে। তিনি জানান, গ্রাম্য কাউন্সিলের নেওয়া সিদ্ধান্তের ফলে তাদের মধ্যে পরিবর্তন এসেছে। তার ভাষ্যে, “এখন আমার সন্তানরা পড়াশোনায় আগের চেয়ে বেশি মনোযোগী হয়েছে। এখন প্রাপ্তবয়স্করা মোবাইলের বাইরেও, নিজেদের মধ্যেও কথাবার্তা বলে।”
পৃথিবীতে ফিরতে ‘প্রেমিকার’ ৩০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিলেন ভুয়া মহাকাশচারী
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।