জুমবাংলা ডেস্ক: কৃষক পরিবারের সন্তান। কৈশোরে জমিতে লাগিয়েছেন রোপা। কেটেছেন ধান। ছুটে বেড়িয়েছেন অবারিত ফসলের মাঠজুড়ে। তিনিই আজ পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি), খন্দকার গোলাম ফারুক। মেধা আর শ্রমে গড়েছেন আজকের জীবন। সম্প্রতি চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত একুশে পত্রিকার প্রতিবেদক শরীফুল রুকনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন তাঁর স্বপ্ন ও স্বপ্নপূরণের কথা, পেশার চ্যালেঞ্জ, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির কথা।
খন্দকার গোলাম ফারুকের জন্ম টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার ঘাটানদি গ্রামে, ১৯৬৪ সালের ১ অক্টোবর। উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত গ্রামেই ছিলেন। সেখানে পড়াশোনা করেন ইব্রাহীম খাঁ সরকারি কলেজে। বাবা মৃত খন্দকার হায়দার আলী ছিলেন কৃষক। মা মোসাম্মৎ ফাতেমা বেগম গৃহিনী ছিলেন। বাবার হাত ধরে কৃষি কাজে যাওয়া খন্দকার গোলাম ফারুক ঠিকমতো পড়াশোনা করার তাগিদটাও পেতেন বাবার কাছ থেকে।
খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, ‘আমি কৃষক পরিবারে জন্ম নিয়েছি। সেই সুবাদে খোলা মাঠ, বিল, ঝিল দাপিয়ে বড় হয়েছি। জমিতে চারা লাগিয়েছি, রোপা লাগিয়েছি, ধান কেটেছি। একেবারে কৃষকের মতো ছোটবেলাটা কাটিয়েছি। পুরোপুরি গ্রামীণ পরিবেশে বড় হয়েছি। আমার বাবা কৃষক হলেও তিনি পড়াশোনার গুরুত্ব বুঝতেন। আমাদেরকে তাগিদ দিতেন লেখাপড়া করতে।’
কিশোর বয়সের একটি ঘটনা এখনো মনে দাগ কেটে আছে খন্দকার গোলাম ফারুকের। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু গিয়েছিলেন টাঙ্গাইলে। তখন ৫ম শ্রেণীতে পড়তেন ফারুক। বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্য সহপাঠী-বন্ধুদের সাথে ট্রাকে করে জনসভায় গেলেন তিনি। বলেন, ‘কাদা-পানি মাড়িয়ে বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্য গেলাম। লক্ষ লক্ষ লোক সেখানে। এক নজর দেখতে পারলাম বঙ্গবন্ধুকে। কী যে খুশি হলাম। জীবনে এটাই একমাত্র, বঙ্গবন্ধুকে সামনাসামনি দেখার সুযোগ।’ বলতে বলতে গলা ধরে আসে ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুকের।
এদিকে এসএসসি ও এইচএসসিতে ভালো ফলাফল করার পর ঢাকার শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন খন্দকার গোলাম ফারুক। তখনও জীবনের লক্ষ্য ঠিক করেননি তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধা তালিকায় দ্বিতীয় হয়ে প্রথম শ্রেণীতে পাশ করার পর সেখানে শিক্ষক হওয়ার প্রস্তাব পান। তখন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের জীবন সীমাবদ্ধ মনে হয় খন্দকার গোলাম ফারুকের কাছে। এ কারণে সিদ্ধান্ত নেন বিসিএস দেওয়ার।
কেন পুলিশ হতে চাইলেন? এমন কথার জবাবেই উঠে এল পুলিশের চাকরির প্রতি তাঁর ভালোলাগার কথা। খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, ‘বড় হয়ে কী হবো- সেটা নিয়ে ছোটবেলায় আমার কোনো লক্ষ্য ছিল না। বড় হওয়ার পর লক্ষ্য ঠিক করলাম। আমি বিশেষত একজন কৃষিবিদ। তবুও বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করার পর চিন্তা করলাম বিসিএস দিলে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং জব কোনটা? তখন আমার কাছে মনে হয়েছিল, পুলিশ।’
তবে পুলিশের চাকরি পেতে অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে খন্দকার গোলাম ফারুককে। নবম বিসিএসে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। প্রথম পছন্দ দিয়েছিলেন পুলিশ ক্যাডার, দ্বিতীয়ত প্রশাসন। নবম বিসিএস পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথমদিকে অবস্থান করেও পুলিশের চাকরি পাননি খন্দকার গোলাম ফারুক। তাকে প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দিতে বলা হয়। কারণ তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসান বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে নিয়োগ হঠাৎ বন্ধ রাখেন; তার বক্তব্য ছিল, সেনা কর্মকর্তাদের যেভাবে নিয়োগ দেয়া হয়, ঠিক সেভাবেই পুলিশে উক্ত পদে নিয়োগ দেয়া হবে।
পুলিশ ক্যাডার না পেয়ে হতাশ হওয়ার পরিবর্তে একদম জিদ চেপে গেল খন্দকার গোলাম ফারুকের। প্রশাসন ক্যাডারে যোগদান না করে পুলিশের চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন। এরইমধ্যে দশম বিসিএসের মাধ্যমে আবার পুলিশ ক্যাডার নিয়োগের ঘোষণা দেয়া হয়।
খন্দকার গোলাম ফারুক দশম বিসিএসেও প্রথম পছন্দ দেন পুলিশ, দ্বিতীয় পছন্দ প্রশাসন ক্যাডার। তবে সেবারও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদুল হাসান বিসিএস পুলিশ উঠিয়ে দিয়েছিলেন। দশম বিসিএসে সম্মিলিত মেধাতালিকায় দ্বিতীয় ও প্রশাসন ক্যাডারে প্রথম হন ফারুক। কিন্তু পুলিশ ক্যাডার না থাকায় দশম বিসিএসেও তিনি যোগদান করেননি।
খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, ‘দুইবার বিসিএসে পুলিশ ক্যাডার না নেয়ার পর সরকার পুলিশের জন্য স্পেশাল সার্কুলার দিল। তখন স্বপ্নপূরণের জন্য প্রশাসন ক্যাডারে দুবার স্থান পাওয়া সত্ত্বেও যোগদান করিনি। পরবর্তীতে নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৯১ সালের ২০ জানুয়ারি পুলিশে যোগদান করি।’
প্রথম কর্মস্থল ছিল বগুড়া এপিবিএন। ১৯৯৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন খন্দকার গোলাম ফারুক। ১৯৯৯ সালে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে পদোন্নতি পান তিনি। পুলিশ সুপার হিসেবে পদোন্নতি পান ২০০৩ সালে। ঠাকুরগাঁও, কিশোরগঞ্জ, ঝালকাটি, জামালপুর ও ময়মনসিংহে একে একে পুলিশ সুপার (এসপি) হিসেবে দায়িত্বপালন করেন খন্দকার গোলাম ফারুক। ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ছিলেন। এরপর ২০১৬ সালে পদোন্নতি পেয়ে পুলিশের রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি হন।
পুলিশে দীর্ঘ চাকরিজীবনে কী কী চ্যালেঞ্জ ছিল- এই প্রশ্নের উত্তরে ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, ‘২৮ বছর ধরে চাকরি করছি। কত রকম চ্যালেঞ্জ তো দেখলাম পুলিশে। শেষ নেই। একাত্তরে আমি ছোট, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারিনি। একাত্তরের পরবর্তীতে পুলিশে আসার পরে দেখেছি, একাত্তরের পরাজিত শক্রু যারা ছিল তারা বারবার আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের প্রতি হানা দেয়ার চেষ্টা করেছে। আমাদের দেশকে নিয়ে চিনিমিনি খেলার চেষ্টা করেছে। জঙ্গিবাদ নিয়ে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছি। এরপরও সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় আমি বড় বড় অনেক কাজ করেছি।’
‘২০০৫ সালে সারাদেশের ৬৩ জেলায় যখন একযোগে বোমা হামলা হয়েছে, তখন জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়ক আবদুর রহমানের জামাতা আবদুল আউয়ালকে ঠাকুরগাঁও থেকে আমি গ্রেফতার করেছি। এজন্য সরকারের কাছ থেকে পুরষ্কারও পেয়েছিলাম। সে সময় ঠাকুরগাঁওয়ের এসপি ছিলাম আমি।’ -যোগ করেন ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক।
চাকরিজীবনে ডিআইজি ফারুকের দ্বিতীয় কর্মস্থল ছিল চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ (সিএমপি)। ১৯৯৩ সালের ২০ জুন থেকে ১৯৯৫ সালের ২৬ আগস্ট পর্যন্ত সিএমপিতে সহকারী পুলিশ কমিশনার পদে দায়িত্বপালন করেন। সে সময়ের স্মৃতিচারণ করে খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, ‘গোলাম আজমের নাগরিকত্ব বিএনপি সরকার ফিরিয়ে দেয়ার পর লালদিঘী মাঠে সংবর্ধনার আয়োজন করেছিল জামায়াত। তখন গোলাম আজম ইস্যুতে জামায়াত একদিকে, আরেকদিকে সর্বদলীয় জোট। টাইগারপাস থেকে রিয়াজউদ্দিন বাজার পর্যন্ত মিছিল নিয়ে আসছিল সর্বদলীয় জোটের লোকজন। কোতোয়ালী থানা মোড়ে দুই পক্ষ মুখোমুখি। শুরু হয়ে গেল গোলাগুলি। আমিসহ পুলিশ সদস্যরা তখন দুই পক্ষের মাঝখানে। পরে এক পর্যায়ে আমরাও শুরু করলাম গুলি। এ ঘটনায় কয়েকজন নিহতও হয়েছিল।’
সিএমপি থেকে বদলি হয়ে ১৯৯৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে সার্কেল এএসপি হিসেবে যোগ দেন খন্দকার গোলাম ফারুক। সেখানে তিন বছরের বেশী সময় দায়িত্বপালন করেন। স্মৃতি হাতড়ে বলেন, ‘খাগড়াছড়িতে গিয়ে দেখি মহাযুদ্ধ সেখানে। পাহাড়ি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ছিল। ইউপিডিএফ তখন নতুন হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই মারামারি, গোলাগুলি। ভয়াবহ অবস্থা গেছে তখন। এএসপি ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার থাকাকালীন খুব কঠিন সময় পার করেছি আমি। এসপি হওয়ার পর থেকে মোটামুটি শান্তিতে চাকরি করছি।’
পেশার প্রতি যত্নশীল খন্দকার গোলাম ফারুক নিজের কার্যালয়ে তাঁর দায়িত্ব পালন করার ফাঁকেই সাক্ষাৎকারের জন্য কিছু সময় দেন। যতটা দীর্ঘ হতে পারত সেই সাক্ষাৎকার, যতটা খুঁটিনাটি উঠে আসতে পারত কথাবার্তায়, সেটা না হলেও একজন জিআইজি দৈনন্দিন কাজে কতটা ব্যস্ত থাকেন, তার সাক্ষী হয়ে থাকা হলো। কাজের ফাঁকে ডিআইজি ফারুক আক্ষেপ করে বলেন, ‘পুলিশের চাকরিতে রুটিন করে চলার উপায় নেই। হয়তো একটা পরিকল্পনা করলাম, সন্ধ্যার সময় ফ্রি আছি, একটু এক্সারসাইজ করি। পরে দেখা গেল যে, সে সময় একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। কোথায় আর এক্সারসাইজ, দৌড়ে চলে যাই সেখানে। কখন কী করতে হয় কোনো ঠিক নেই।’
গত বছরের ১৪ জুলাই পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন খন্দকার গোলাম ফারুক। পুলিশের দায়িত্বশীল সব কাজ উপভোগ করেন তিনি। তবে কষ্ট একটাই- কাজের কারণে সন্তানদের কাছ থেকে দূরে থাকতে হয়। তিন মেয়ে ঢাকায় পড়াশোনা করছেন। তাদের সঙ্গে রয়েছেন স্ত্রী শারমিন আক্তার খানও।
পুলিশের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের কর্মকর্তা খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, ‘বিপদগ্রস্ত মানুষকে সাহায্য করতে আমি সবসময় চেষ্টা করি। যতদিন চাকরি আছে, মানুষ যাতে ন্যায়বিচার পায় সেটা নিশ্চিত করতে কাজ করবো।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।