ডা. সাঈদ এনাম : ধুতরাগাছের বৈজ্ঞানিক নাম এট্রোপা বেলাডোনা (Atropa Belladonna)। বেলাডোনা (Belladonna) শব্দটি ইতালিয়। বেলা ‘Bella’ অর্থ সুন্দরী আর ডোনা ‘Dona’ শব্দের অর্থ ‘রমণী’। অর্থাৎ ‘সুন্দরী রমণী’। তৃতীয় বা চতুর্দশ শতকের দিকে ইতালীয় রানিরা নিজেদের চোখ এবং ত্বককে আকর্ষণীয় করতে ধুতরা ফলের রস চোখ ও ত্বকে ব্যবহার করতেন। এট্রোপিন (Atropine) থাকায় নাম এট্রোপা (Atropa)।
ধুতরার ফলের ‘Atropine’ যা চোখের মনিকে বড়ো করে (Dialated Pupil) ফলে চোখ চকচকে, মোহণীয় এবং অপেক্ষাকৃত বড় দেখায় (Seductive eyes/Bedroom eyes) আর ত্বক হয় কোমল ও মসৃণ।
রূপে তুলনাহীন মিশরীয় সম্রাজ্ঞী, মৃত্যুর হাজার বছর পরও যার রূপের গুণকীর্তন করেছেন শেক্সপিয়ার থেকে শুরু বিখ্যাত সব কবি-সাহিত্যেক। সেই সৌন্দর্যের প্রতীক, মিশরীয় রানি ক্লিওপেট্রা (Cleopatra), তার চোখকে আকর্ষণীয় ও মোহনীয় করতে (Seductive eyes/ Bedrooms Eyes) চোখে ব্যবহার করতেন ধুতরার নির্যাস।
ক্লিওপেট্রার রূপের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল তার ডাগর ডাগর চোখ আর মোহসীয় চাহনী (Seductive eyes), যাতে মূহুর্তেই ধরাশায়ী হয়ে যেতেন দ্বিগ্বিদিক জয়ী রোমান সম্রাট। সে যুগে ডাগর ডাগর চোখের মোহনীয় চাহনী (Seductive eyes or Bedroom eyes) ছিল রূপ আর সৌন্দর্যে ‘আভিজাত্যের’ প্রতীক।
তবে দীর্ঘদিন ব্যবহারে এট্রোপিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় চোখ ডাগর ডাগর দেখালেও দৃষ্টিশক্তি ড্যামেজ হয়ে যেত বলে পরবর্তীতে এর ব্যবহার কমে যায়।
ধুতরার এমন ব্যবহারেই উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ক্যারোলাস লিনিয়াস ধুতরার বৈজ্ঞানিক নাম দেন ‘এট্রোপা বেলাডোনা’ (Atropa Belladonna)।
ধুতরাপাতা ও ফলের উপাদান হলো আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক উপাদান ‘স্কোপোলামিন’ (Scopolamine) । এই ‘স্কোপোলামিন’কে নিঃশ্বাসের সঙ্গে নিলে বা ত্বকের মাধ্যমে শোষিত হয়ে রক্তে মিশলে তা দ্রুত ব্রেইনে পৌঁছে যায় এবং সাময়িক সময়ের জন্য মানুষের ব্রেনকে অকেজো করে। ফলে মানুষ অনেকটা বোকার মতো হয়ে যায় (Stuporous Condition) , বিবেক-বুদ্ধি-বিবেচনা হারিয়ে ফেলেন ( Loss of Cognitive power), অন্যের কথায় চলেন, (Loss of Self Control)।
ক্ষেত্রবিশেষে তীব্র বিষক্রিয়ার প্রভাবে রোগী অনেক সময় উন্মাদের মতো শুরু আচরণ করতে পারেন। তার মধ্যে নানান সাইকিয়াট্রিক সিমটম (প্স্যছিয়াত্রিচ Symptoms) যেমন হ্যালুসিনেশন (Hallucination), ভ্রান্ত চিন্তা-ডিলিউসন (Delusion), গায়েবী শক্তির অধিকারী ভাবা (Delusion of Possession) অগোছালো কথাবার্তা (Disorganized Speech), অগোছালো কাজ (Disorganized Behaviour)।
অনেকের ধারণা, ধুতরায় যেহেতু স্কোপোলামিন (Scopolamine) আছে এবং এটা সহজলভ্য, তাই শত্রুতা বশত বন্ধুরূপী শত্রু অসৎ উদ্দেশ্যে নিয়ে অনেক সময় ধুতরা ফলের রস খাবারে মিশিয়ে দেয়। ফলে রসে থাকা ক্ষতিকর স্কোপোলামিন রাসায়নিক পদার্থের প্রভাবে সে অত্যন্ত বাধ্য আচরণ করে, তার বিবেক-বুদ্ধি, বিবেচনা লোপ পায়, অনেক ক্ষেত্রে উন্মাদের মতোও আচরণ করে।
অজ্ঞতার আর কুসংস্কারের জন্য অনেক সময় এ অবস্থাকে মানুষ ভাবেন “জাদু-টোনা-বান”, বা ‘ব্ল্যাক ম্যাজিক’। “দুষ্টু ভণ্ড কবিরাজ”, “ভণ্ড মোল্লা”, “ভণ্ড-তান্ত্রিক সাধক” বাবারা এই অজ্ঞতার সুযোগ নেয়। তারা একে ‘ব্ল্যাক ম্যাজিকের’ আছর বলে ব্যবসা করে।
অনেকের মতে ‘ভণ্ডতান্ত্রিক’, ‘ভণ্ডসাধক’, ‘ভণ্ডপীর’ বাবারা ‘জাদু-চালান’ বা ‘ব্ল্যাক ম্যাজিক’ এর নামে মূলত ধুতরার নির্যাস স্কোপোলামিন ব্যবহার করে। তারা তাদের ছেড়া ঝোলায় স্কোপোলামিন পাউডার রাখে, যা ছোট শিশিতে তুলে দিয়ে বলে অবাধ্য স্বামী-স্ত্রী বা প্রেমিক-প্রেমিকার চুলে বেঁধে দিতে বলে বা লুকিয়ে পানিতে চুবিয়ে পানি খাইয়ে দিতে বলে।
স্কোপোলামিনের প্রভাবে ‘স্বামী-স্ত্রী’, ‘প্রেমিক-প্রেমিকা’ সত্যি সাময়িক স্টিউপর ( Stuporous Condition) হয়ে যায়, বুদ্ধি-বিবেচনা হারিয়ে ফেলেন এবং উন্মাদের মতো আচরণ করেন। সত্যি হয় দুষ্টু বাবাদের কেরামতি।
ধুতরার স্কোপোলামিনকে কেন শয়তানের নিঃশ্বাস বলা হয়?
ধুতরার স্কোপোলামিন দ্রুত ব্রেনের ‘ব্লাড ব্রেন বেরিয়ার’ (Blood Brain Barrier-BBB ) নামে একটি ছাকুনি বা পর্দা দিয়ে প্রবেশ করে দ্রুত আমাদের ব্রেনে পৌঁছে যায়। ফলে ব্রেনের কোষ তার স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা সাময়িক সময়ের জন্য হারিয়ে ফেলে।
এতে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে যায়, আক্রান্ত রোগীর মাঝে নানান সাইকিয়াট্রিক সিমটম ( Psychiatric Symptoms) যেমন হ্যালুসিনেশন (Hallucination), ভ্রান্ত চিন্তা-ডিলিউসন (Delusion), গায়েবী শক্তির অধিকারী ভাবা (Delusion of Possession) অগোছালো কথাবার্তা (Disorganized Speech), অগোছালো কাজ (Disorganized Behaviour), (Cognitive Impairment) দেখা দেয়।
রোগী রোবটের মতো একান্ত বাধ্য আচরণ করে (Stuporous Condition) ক্রিমিনালের সব আদেশ-নিষেধ মানতে থাকে। সেই সুযোগে ক্রিমিনাল সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে নেয়, এমনকি শ্লীলতাহানিও করে। এসব ক্রিমিনালের প্রধান টার্গেট থাকে সাধারণত কিশোরী, তরুণী, নারী। এ জন্য একে শয়তানের নিঃশ্বাস (Devil’s Breath) বলে।
স্কোপোলামিন কিডনির মাধ্যমে দেহ থেকে বের হয়ে গেলে রোগীর সম্বিত ফিরে আসে। রোগী ধীরে ধীরে সব বুঝতে পারেন।।
তবে কোন কোন সময় বিষক্রিয়ার পরিমাণ বেশি হলে ভিকটিম মারা যেতে পারে। কথিত আছে— রোমান সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ সম্রাট অগাস্টাস (Augustus) কে ধুতরা পয়জনিং করে উন্মাদ বানিয়ে হত্যা করেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী লিভিয়া (Livia)।
এসব কারণেই স্কোপোলামিনকে শয়তানের নিঃশ্বাস বা ডেবিলস ব্রেথ ও বলা হয়।
লেখক: ডা. সাঈদ এনাম
এম বি বি এস (ডিএমসি) এম ফিল (সাইকিয়াট্রি)
ব্রেইন, স্নায়ু ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ।
সহকারী অধ্যাপক, সিলেট মেডিকেল কলেজ।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।