জুমবাংলা ডেস্ক : মধ্যরাতে ঘরের দরজা ভেঙে সাংবাদিককে তুলে নিয়ে নির্যাতনের ঘটনায় সদ্য প্রত্যাহার হওয়া কুড়িগ্রামের ডিসি মোছা. সুলতানা পারভীনের বিরুদ্ধে আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এ দিকে কুড়িগ্রামের সিনিয়র সহকারী কমিশনার (আরডিসি) নাজিম উদ্দিন প্রত্যাহার হয়ে বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগ্যানকে মধ্যরাতে ধরে নিয়ে নির্যাতনের ঘটনায় নতুন করে আলোচনায় এসেছেন। তবে তার অপকর্ম এটাই প্রথম নয়, এর আগেও মধ্যরাতে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে অনেককেই সাজা দিয়েছেন তিনি, যাদের বেশিরভাগই নিরীহ।
মানুষকে ভয়ভীতি দেখানো ছিল তার একটি নেশা। ২০১৮ সালে কক্সবাজারে ষাটোর্ধ্ব মোহাম্মদ আলী ওরফে নফু মাঝিকে কান ধরে টেনেহিঁচড়ে মারধর করেছিলেন তিনি। সেই নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় ওঠে। ২০১৯ সালে মাগুরার এসিল্যান্ড থাকা অবস্থায় সাধারণ মানুষকে মারধর, বাড়িঘর ভাঙচুরসহ তার বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতির অভিযোগে বিভাগীয় মামলাও হয়েছে।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে আলোচনায় এসেছে দরিদ্র পরিবারের সন্তান নাজিমের হঠাৎ বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হওয়ার বিষয়। সরকারি চাকরি পাওয়ার ছয় বছরের মাথায় হঠাৎ বিত্তবান হওয়ায় বিস্মিত এলাকাবাসীও। এদিকে সাংবাদিক আরিফুল ইসলামের নির্যাতক সদ্য প্রত্যাহার হওয়া কুড়িগ্রামের রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর (আরডিসি) নাজিম উদ্দীন অবশেষে মুখ খুললেন। ঘটনার তিন দিন পর গতকাল মঙ্গলবার নাজিম বলেছেন আমি আরিফ ভাইকে মারিনি। আমাদের যে শাস্তি হওয়ার তা হয়েছে। ওই ঘটনায় আমাদের যাদের নাম এসেছে তাদের সবাইকে ওএসডি করা হয়েছে। এদিকে আগামী সোমবার উচ্চআদালত সাংবাদিক আরিফের বক্তব্য শুনবে। তার আগেই ডিসি এক প্রস্তাব দিলেন। জানা গেছে, জামিনে মুক্ত হওয়ার পর সাংবাদিক আরিফুল ইসলামকে ফোন দিয়েছিলেন সুলতানা পারভীন। নিজেকে রক্ষায় মিডিয়ার সামনে আরিফকে কথা না বলার জন্য অনুরোধও করেছিলেন তিনি। আরিফের সঙ্গে ডিসি সুলতানার কথোপকথনের একটি অডিও প্রকাশ পেয়েছে।
ওই অডিওতে ডিসি সুলতানা পারভীনকে বলতে শোনা যাচ্ছে- এখন মিডিয়াকে অ্যাভয়েড (এড়ানো) করে থাকো। মিডিয়াতে কথা বলো না। দেখা যাক আল্লাহ ভরসা। তোমার ভবিষ্যৎ নিয়ে আপাতত চিন্তা করার দরকার নেই। ভবিষ্যতের নিরাপত্তা নিয়েও চিন্তা করার কিছু নেই। আমরা তোমার পাশে থাকব। তোমার মামলা প্রত্যাহার করে নেব। একটু সময় দিও। একটু পজিটিভলি দেখতে হবে।
জামিন নিয়ে কারাগার থেকে বের হওয়ার পর পরই এক ব্যক্তির মাধ্যমে সাংবাদিক আরিফুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করে এ প্রস্তাব দিয়েছিলেন ডিসি সুলতানা পারভীন। আরিফকে ফোনালাপে বলেন, যাই হোক একটি ঘটনা ঘটে গেছে। তুমি একটু রেস্ট নাও। যাও, একটু নিরিবিলি থাকো। এ কথোপকথনে তিনি যে পুরো ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
কথোপকথনে এনকাউন্টারে দেয়ার হুমকি পাওয়ার মতো অপরাধ করেছেন কিনা সাংবাদিক আরিফ তা জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক বলেন, এনকাউন্টারের মানসিকতা আসলে আমাদের ছিল না। ওইভাবে ছিল না। ওই অডিও রেকর্ডে শোনা যায়, ডিসি সুলতানা পারভীন আরিফের কাছে প্রথমে তার অবস্থা জানতে চান। আরিফ তখন তাকে বেধড়ক মারধর কেন করা হয়েছে তা জানতে চান। একই সঙ্গে তার কাছ থেকে চোখ বাঁধা অবস্থায় স্বাক্ষর নেয়া চারটি কাগজ ফেরত চান।
ডিসি সুলতানা পারভীন বলেন, আচ্ছা ঠিক আছে, আমি তোমাকে ফেরত দেব… কথা বলে নিজে আমি তোমাকে ফেরত দেব… যদি নিয়ে থাকে ওরা। কোন কাগজে সই নিয়েছে। তোমার মোবাইল কোর্টের ইয়াতে সই ছিল, বুঝছো। আরিফ এ সময় বলেন, আমার চোখ বাঁধা অবস্থায় চারটা সই নিয়েছে। ডিসি বলেন, মোবাইল কোর্টের আদেশে তোমার সই নিয়েছে। ওটা মোবাইল কোর্টের ইয়াতেই। আচ্ছা, যাই হোক এখন ঘটনা যেভাবে ঘটে গেছে, যা ঘটেছে তুমিও ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেইখো। আমি নিজেও আসলে অনুতপ্ত। তুমি একটু রেস্ট নাও। যাও। থাকো। নিরিবিলি একটু থাকো, ঠিক আছে।
আরিফুল ইসলাম এ সময় এনকাউন্টার দেয়ার মতো অপরাধ করেছেন কিনা তা ডিসির কাছে জানতে চান। এর জবাবে ডিসি সুলতানা পারভীন বলেন, এনকাউন্টারের মানসিকতা আসলে আমাদের ছিল না। ওইভাবে ছিল না। আরিফ ডিসিকে বলেন, আপনি আমাকে একদিন ডাকতে পারতেন, আমি কি আসতাম না? এর উত্তরে ডিসি বলেন, না, সেটা আসতা। এখনও আসবা, সমস্যা নাই। এখন ধরো যে, কষ্ট তো তুমিও পাচ্ছো, কষ্ট আমিও… হয়ে গেছে যেটা, এটা এদিকে দেখতে হবে একটু পজিটিভলি। এটাই বলার জন্য.।
এ সময় ডিসিকে উদ্দেশ করে আরিফ বলেন, তারা কী উদ্দেশ্যে এই কাজটি করলেন এটা আমার জানা বাঞ্ছনীয়। এবং তারা আমার চারটি কাগজে সই নিয়েছে, কেন নিয়েছে এটা আমার দেখতে হবে। আমার দুই নামেই সই নিয়েছে তারা। এবং আমি আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে খুবই চিন্তিত। ডিসি বলেন, তোমার ভবিষ্যৎ নিয়ে এতটা চিন্তিত হওয়ার কিছু নাই। চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিয়ে, ভালো থাকবা ইনশাল্লাহ।
মিডিয়ায় ডাকতে পারে জানালে ডিসি বলেন, এখন কি করতে চাচ্ছো? আমি যেটা বলবো যে এখন মিডিয়াকে অ্যাভয়েড করে থাকো। যাও। দেখা যাক আল্লাহ ভরসা। আমরাও তোমার পাশে আছি আর কী। আরিফ এ সময় আবার চোখ বাঁধা অবস্থায় স্বাক্ষর করা কাগজের প্রসঙ্গ ডিসি বলেন, ঠিক আছে আমি খোঁজ নিয়ে দেখি। এটা তো মোবাইল কোর্টের নির্দেশনাতেই ছিল। অন্য কিছুতে নেয়নি। আর তোমার বিষয়ে অত ইয়া তো আমাদের…যাই হোক…ঘটনাটা ঘটেছিল।
মামলা প্রসঙ্গে ডিসি বলেন, তোমার মামলা প্রত্যাহার করে দেব, সমস্যা নাই। একটু সময় দিও। একটা-দুইটা শুনানির সময় লাগবে। তোমার চাকরির ব্যাপারেও আমি দেখব। চাকরির ব্যাপারে কোনো টেনশন করো না। এ ব্যাপারে আরিফুল ইসলাম বলেন, কারাগার থেকে বের হওয়ার পর জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন এক ব্যক্তির মাধ্যমে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
এ সময় আমি তার সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে চাই। আমি তাকে কিছু প্রশ্ন করি। তিনি এসব প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। তিনি আমাকে মামলা প্রত্যাহার করে নেয়ার আশ্বাস দিয়ে চুপচাপ থাকতে বলেন। আমি আসলে তখন আতঙ্কিত ছিলাম। আমি আমার ভবিষ্যৎ নিয়েও চিন্তিত ছিলাম। তবে আরিফের সঙ্গে কথোপকথনের বিষয়ে সুলতানা পারভীনের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
কুড়িগ্রাম থেকে সদ্য প্রত্যাহার হওয়া আরডিসি নাজিম উদ্দীন গতকাল মঙ্গলবার নাজিম বলেন আমি আরিফ ভাইকে মারিনি। আমাদের যে শাস্তি হওয়ার তা হয়েছে। ওই ঘটনায় আমাদের যাদের নাম এসেছে তাদের সবাইকে ওএসডি করা হয়েছে। এসব নিয়ে তার বিরুদ্ধে আর কোনো সংবাদ না প্রকাশ করতেও অনুরোধ করেছেন নাজিম। সাংবাদিক আরফিকে নির্যাতনের বিষয়ে জানতে স্থানীয় এক সাংবাদিককে এমনটাই জানিয়েছেন নাজিম।
নাজিম যশোরের মনিরামপুর উপজেলার দূর্বাডাঙ্গা গ্রামের মৃত নিছার উদ্দিনের ছেলে নাজিম উদ্দিন খেদাপাড়া ইউনিয়নের কাশিপুর গ্রামে নানাবাড়িতে বড় হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করে ২০১৪ সালে ৩৩তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়ে প্রথমবারেই উত্তীর্ণ হয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হন। তার চাকরির ব্যাপারে স্থানীয় একজন জনপ্রতিনিধির সুপারিশ ছিল বলেও জানা গেছে।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার পর থেকে নাজিম এলাকার মানুষকে কারণে-অকারণে ভয় দেখাতেন। কুড়িগ্রামে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় নাজিমের জড়িত থাকার বিষয়টি জানাজানি হলে অনেকে তার ব্যাপারে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। তার হঠাৎ অর্থবিত্তের মালিক হওয়া নিয়েও চলছে আলোচনা।
কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার ভিতরবন্দ ইউনিয়নের বিশ্বনাথ দাসের পরিবার ভয়াবহ নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে বাড়ির সবাইকে মারধর করে বিশ্বনাথকে তুলে নিয়ে সেই রাতেই ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে এক বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়। মজনু নামের আরেকজনকে দেয়া হয় ছয় মাসের কারাদন্ড। পরদিন মজনুকে জামিন দিলেও বিশ্বনাথ ছাড়া পাননি। ২০ দিন ধরে কারাগারে আছেন পেশায় জেলে বিশ্বনাথ দাস। তাদের দেয়া দন্ডের কোনো নথিপত্রও দেননি নাজিম উদ্দিন।
বিশ্বনাথের কাকা স্বপন চন্দ্র বর্মন, স্ত্রী পার্বতী রানী দাস, বোন শুক্লা দাস ও ভাই বাবলু নম দাস জানান বিশ্বনাথ, পঞ্চয়েতপাড়ার আঙ্গুর ও মোখলেছ মিলে উন্মুক্ত জলাশয় গিরাই নদীর দেবীকুড়ায় বাঁধ দিয়ে মাছের পোনা ছেড়েছিল। এটাই ছিল তাদের অপরাধ। এখানে মাছের পোনা ছাড়ার আইনগত বাধা না থাকলেও ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১২টার দিকে নাজিম উদ্দিনের নেতৃত্বে পুলিশসহ কিছু কর্মকর্তা বাড়িতে ঢুকে মারধর করে বিশ্বনাথকে ধরে নিয়ে যায়। এ সময় বিশ্বনাথের স্ত্রী, মা, কাকা ও ভাইকে মারধর করা হয়। এরপর তারা যায় আঙ্গুর ও মোখলেছের বাড়ি। সেখানে গিয়েও বাড়ির লোকজনকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে। আঙ্গুর ও মোখলেছকে বাড়িতে না পেয়ে ধরে নিয়ে যায় আঙ্গুরের বাবা মজনুকে। রাতেই ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে বিশ্বনাথকে এক বছর ও মজনুকে ছয় মাসের কারাদন্ড দেয়া হয়।
কক্সবাজার সদর উপজেলায় এসিল্যান্ড থাকাকালে ২০১৮ সালের মে মাসে শহরের কলাতলী এলাকার মোহাম্মদ আলী ওরফে নফু মাঝি (৬২) নামে এক বৃদ্ধকে কান ধরে টেনেহিঁচড়ে মারধর করেন নাজিম উদ্দিন। নির্যাতনের ওই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে এ নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। নফু মাঝি বলেন, নির্মম ওই ঘটনার কথা আর মনে করতে চাই না।
কক্সবাজারের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এনভায়রনমেন্ট পিপলসের প্রধান নির্বাহী ও সাংবাদিক রাশেদুল মজিদ বলেন, তৎকালীন এসিল্যান্ড নাজিম উদ্দিনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছিলাম। সেই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আমাকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে হাজির হতে বলা হয়। আমি হাজির হলেও নাজিম সেখানে উপস্থিত হননি। পরে তাকে শাস্তিমূলকভাবে রাঙামাটির লংগদুতে বদলি করা হয়।
২০১৮ থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলায় এসিল্যান্ড হিসেবে কর্মরত ছিলেন নাজিম উদ্দিন। সে সময় তিনি সাধারণ মানুষের সঙ্গে অসদাচরণ, মারধর, বাড়িঘর ভাঙচুরসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন। পরে এসিল্যান্ড নাজিমের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার নামে মানুষের দোকান ভাঙচুর, ব্যবসায়ীদের নাজেহালসহ নানা অভিযোগ রয়েছে।
মাগুরার জেলা প্রশাসক ড. আশরাফুল আলম বলেন, সাবেক এসিল্যান্ড নাজিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে সে সময় বিভাগীয় মামলা হয়। তার বিরুদ্ধে অসদাচরণ, অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। সূত্র : ইনকিলাব
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।