ড. আলা উদ্দিন: বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রফেসর ড. গাজী সালেহ উদ্দিন গত বছর আগস্ট মাসের ৬ তারিখ ইহলোক ত্যাগ করে পরলোকের বাসিন্দা হন। গাজী সালেহ উদ্দিন ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গণের একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন; যুদ্ধ করেছেন চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীতে। কর্মজীবনে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও সভাপতি ছিলেন; সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ছিলেন; শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন; বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও তাঁর একটা ব্যাপক জগৎ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসরের পর নানা প্রতিষ্ঠানের সাথে তাঁর সংযোগও অনেকটা হ্রাস পায়। তবে করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে তাঁর বন্দী জীবন তাঁকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দেয়।
মৃত্যুর সপ্তাহ খানেক আগে তিনি চট্টগ্রামের সিআরবি’র সবুজ প্রকৃতিকে হাসপাতাল নির্মাণের বাণিজ্য থেকে রক্ষার আন্দোলনে সিআরবি’তে সমাবেশ করেছিলেন, বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তাছাড়া তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠিত নৈতিক স্কুলে অসহায় শিশুদের সাথে নিত্য যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছিলেন। ধারণা করা হচ্ছে সিআরবির সমাবেশ কিংবা নৈতিক স্কুলের সংযোগ থেকে তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন।
করোনায় আক্রান্ত হলেও ড. গাজী সালেহ উদ্দিনের ধারণা ছিল তাঁর যেহেতু টিকার দুটি ডোজ নেওয়া আছে, অসুবিধা হবে না। ছেলে-মেয়ের জোরাজুরিতে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়, যেহেতু তারা দুই জনই ঢাকায় থাকে। তাছাড়া তিনি চট্টগ্রামে একা থাকেন, তাঁর স্ত্রী মারা গেছেন সাত বছর কয়েক আগে। ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ৬ আগস্ট করোনাভাইরাসের কাছে হার মানেন তিনি। সবাইকে কাঁদিয়ে চলে যান না ফেরার দেশে।
তাঁর মনোবল ও ফেসবুকে সাহসী কথায় এবং জীবনভর তাঁর সংগ্রামের কারণে সবার আশা ছিল গাজী-কে কাবু করার মতো করোনাভাইরাস অতোটা শক্তিশালী না। উনি আবার ১৯৭১ এর মতো গাজী হয়ে সবার মাঝে ফিরে আসবেন। তিনিও আশাবাদী ছিলেন, যা তার ফেইসবুক স্ট্যাটাস থেকে জানা যায়। আমৃত্যু দৃঢ় মনোবল নিয়ে বেঁচে ছিলেন সদা সাদা মনের অধিকারী গাজী সালেহ উদ্দিন। কিন্তু, না, তিনি আর গাজী হয়ে ফিরে আসতে পারলেন না, শহীদ হয়ে ফিরে গেলেন পিতৃনিবাস নোয়াখালীর বুকে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজী সালেহ উদ্দিনকে শেষ বিদায় জানাতে রাষ্ট্রীয়ভাবে গার্ড অব অনার দেওয়া হয় চট্টগ্রামে। আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক শোকবার্তা পাঠিয়েছিলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রোভিসিসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী তাঁকে হারানোর ব্যাথায় অনেক দুঃখ পেয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও তিনি অনেক সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সাথে (যেমন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, খেলাঘর, ইত্যাদি) সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। সবকিছু ছেড়ে তিনি চিরতরে পরকালে পাড়ি দিলেন। এই এক বছরে আমরা নানান দুঃসময়ে অনুভব করলাম তিনি আর আমাদের মাঝে নেই। আর কোনো দিন কারও কারও বিপদে, কিংবা সামাজিক আন্দোলনে তাঁকে সশরীরে পাওয়া যাবে না।
২০০১ থেকে ২০০৭ সময়কালে আওয়ামী লীগ যখন বিরোধী দলে, তখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়-সহ চট্টগ্রাম নগরের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনেন সবসময় সোচ্চার ছিলেন। তিনি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পছন্দ করতেন, এবং তাঁর নীতি, সততা ও স্পষ্টবাদিতার গুণে সকল চ্যালেঞ্জে জয়ী হতেন। পরিস্থিতি বুঝে ব্যবস্থা গ্রহণের বিশেষ ক্ষমতা ছিল তাঁর। নিজে খুব সাহসী ছিলেন, অন্যদেরও সাহস জোগাতে পারতেন।
তিনি যদিও সমাজতত্ত্বের শিক্ষক ছিলেন, বিভাগ ও শ্রেণিকক্ষের বাইরে তার পরিচয় ছিল আরও অনেক ব্যাপক। নিজ বিভাগের বাইরেও অন্যান্য অনেক বিভাগের শিক্ষার্থীদের কাছেও তিনি অত্যন্ত প্রিয়ভাজন ছিলেন, তাঁর পরোপকারী ও বন্ধুবৎসল বৈশিষ্ট্যের জন্য। সবার বিপদে যেমনি তাঁকে পাওয়া যেত, জাতির যে কোন সঙ্কটময় মুহূর্তে মানবতাবাদী প্রগতিশীল প্রাণ গাজী সালেহ উদ্দিন সদা প্রস্তুত ছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, যে যুদ্ধে তাঁর পিতাও শহীদ হন। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে তিনি সোচ্চার ছিলেন। তিনি ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির চট্টগ্রাম এর সভাপতি ছিলেন; খেলাঘরের কর্ণধার ছিলেন।
শুধু বাহিরের অঙ্গনে নয়, পরিবারের অঙ্গনেও তিনি সমান জনপ্রিয়। তিনি সফল পিতা। তার দুই সন্তান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স করা। তাঁর ছেলে সচিবালয়ের সিনিয়র কর্মকর্তা। মেয়েও বেসরকারি সংস্থার সাথে জড়িত। তার স্ত্রী নাসিরাবাদ মহিলা কলেজের উপাধ্যক্ষ অবস্থায় অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদানের অল্প কয়েকদিন আগেই ২০১৪ সালে হৃদরোগে মারা যান। পরিবারের সকলের কাছে তিনি অত্যন্ত বন্ধুবৎসল ছিলেন। তাঁর গাড়ির ড্রাইভার, কাজের মানুষ সবাই তার কাছে খুব প্রিয় ছিল। তাঁর কাজের মানুষ আব্দুল ছিলেন তাঁর ফেইসবুক স্ট্যাটাস-এর নেপথ্য চরিত্র, যা তাঁর নিজস্ব সৃষ্ট। তাঁর মনের কথা আব্দুলের ভাষ্যে প্রকাশ করতেন। আমরা সেই উপভোগ্য ও শিক্ষণীয় সমাজ বাস্তবতার চিত্র থেকে বঞ্চিত হয়ে গেলাম।
গাজী স্যার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সেক্রেটারি নির্বাচিত পর সারা দেশের বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফেডারেশনের সেক্রেটারিও হন। সেই সময় সারা দেশ সংগ্রামে উত্তাল। ২০০৪ সালের ২১ আগষ্টে আওয়ামীলীগের সভাপতি শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা এবং ২০০৫ সালে আওয়ামীলীগের সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যাকান্ড ইত্যাদি ঘটনার তীব্র প্রতিবাদে তিনি সর্বদা শিরোভাগে ছিলেন। আন্দোলনের অংশ হিসেবে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় যেতে হয়েছিল বেশ কয়েকবার। আমিও দুয়েকবার উনার বহরে ছিলাম। প্রয়াত অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া হত্যার প্রতিবাদ সমাবেশে, ঢাকা শহীদ মিনারে অংশগ্রহণ করেছিলাম আমরা। একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার পর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা সুস্থ হয়ে ওঠার পর তাঁর সাথেও আমরা সাক্ষাৎ করেছিলাম ধানমন্ডিস্থ দলীয় কার্যালয়ে।
জ্ঞান অন্বেষণ ও তা পত্রিকায় কলাম বা বই আকারে প্রকাশ করা প্রতি অধ্যাপক গাজী সালেহ উদ্দিনের বিশেষ আগ্রহ ছিল। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে “প্রামাণ্য দলিল: মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম” তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্জন। বইটি লিখতে তাঁকে অনেক বেগ পেতে হয়েছে, অনেক পুরোনো নথি, মামলার কাগজ ইত্যাদি জোগাড় করতে হয়েছে। অনেক কষ্ট করে কাজটি করেছিলেন বলে ১৯৭১-এ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যেআন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বিচার কার্যক্রমে তাঁর বইটিকে রেফারেন্স হিসেবে বিশেষ স্বীকৃতি দিয়েছে। ”চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়: আমার আমি’ বইয়ে তিনি তার কর্মস্থল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা ঘটনাচক্র সহজ-সরল ভাষায় বর্ণনা করেছেন। তার সর্বশেষ বই ‘শমসের গাজী’ (২০২১) লিখার জন্য তাকে সদা উৎসুক লক্ষ্য করা যেত। এই বইটি লিখার জন্য, বিভিন্ন উপাত্ত ও নথি, পুরাতন দলিল, ইত্যাদি সংগ্রহ করার জন্য নানা জায়গায় গেছেন, নানা মানুষের সাথে কথা বলেছেন। তিনি কুমিল্লা, ফেনী, সোনাগাজী, এমনকি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় গিয়েও প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সংগ্রহ করেছেন।
সারা জীবন গাজী সালেহ উদ্দিন আন্দোলন-সংগ্রাম করে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত বধ্যভূমি রক্ষা আন্দোলনে তিনি ছিলেন অকুতোভয় বীর। প্রাণের হুমকিকে তোয়াক্কা না করে তিনি আন্দোলন চালিয়ে গেছেন, পুরোপুরি সাফল্য এখনো আসেনি। মৃত্যুর অল্প কয়েকদিন আগে ২০২১ সালের ২৬ জুলাই ফেইসবুক স্ট্যাটাসে তিনি আরেকটি বই প্রকাশ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল আন্দোলনের ওপর। তিনি ফেইসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে এ বিষয়ে তথ্যাদি দিয়ে তাঁকে সহায়তা করার জন্য আহ্বান করেছিলেন। স্ট্যাটাস-এ তিনি উল্লেখ করেছিলেন ২০০৭ সালে যখন আওয়ামীলীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে ১/১১ সরকার গ্রেপ্তার করেছিল, গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে সচেতন শিক্ষক সমাজের ব্যানারে একটি বিবৃতি তৈরী করা হয়েছিল। সে বিবৃতিতে চারজন স্বাক্ষরকারীর কথা তাঁর স্মরণে ছিল: ইসলামের ইতিহাসের অধ্যাপক ড. আবু ইউসুফ, অধ্যাপক ড. গোলাম কিবরিয়া ভূঁইয়া, তিনি (অধ্যাপক ড. গাজী সালেহ উদ্দিন) এবং আমি (নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আলা উদ্দিন)। এই বিবৃতির কারণে তাঁকে এবং অধ্যাপক আবু ইউসুফকে ডিজিএফআই অফিস ডেকে পাঠিয়েছিল।
মানুষকে সহায়তা করতে পারলে নিজেও ভীষণ আনন্দ পেতেন। অঞ্চল, দল-মত নির্বিশেষে পরিচিত, অপরিচিত অসংখ্য মানুষ উনার সহযোগিতা পেয়েছে, উনিও তাদের কাছ থেকে যথাযথ সম্মান পেয়েছেন। এমন প্রাণচঞ্চল, প্রফুল্য, হাসিখুশি, সদালাপি, সত্যবাদী, নির্লোভ মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। তাঁর একটা বড় দোষ ছিল তিনি কোনো অনিয়ম, অন্যায়ের কথা জানতে পারলে তার প্রতিবাদ করতেন, কিংবা সংবাদ মাধ্যম উনার কাছে কিছু জানতে চাইলে মিথ্যা বলতে পারতেন না, বা বিষয়টা লুকাতেন না। এ জন্য অনেক ক্ষমতাবান উনার উপর নারাজ ছিলেন, কিছু সংখক বন্ধু শত্রুতে পরিণত হয়েছিল।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মৃত্যুর তিন বছর পূর্বে তিনি অবসর নিয়েছেন। অবসর নেয়ার পর থেকে তিনি তাঁর বাড়ির ছাদে গাছ, মাছ ও পাখির জগৎ তৈরী করেছিলেন। পাশাপাশি স্থানীয় ঝরে পড়া অনাথ শিশুদের জন্য (যারা প্রথাগত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নৈতিক স্কুল। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি যে ভাতা পেতেন সেটা তিনি এই স্কুলের জন্য ব্যয় করতেন। এই স্কুলের ছেলেমেয়েদের মাঝে তাঁর যে হাসিমাখা মুখচ্ছবি দেখা যেত, তাতেই বুঝা যেত তিনি কত বড় সাদা মনের মানুষ ছিলেন। তাঁর উদ্যোগে অভিভূত হয়ে ইত্যাদি’র জনপ্রিয় নির্মাতা হানিফ সংকেত ইত্যাদি অনুষ্ঠানে নৈতিক স্কুলের উপর একটি অনুষ্ঠান করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর নৈতিক স্কুলেরও মৃত্যু ঘটেছে বলা যায়।
গাজী সালেহ উদ্দিনের জীবন মানে আন্দোলন, সংগ্রাম। আমৃত্যু তাই ছিল। তাঁর সর্বশেষ আন্দোলন ছিল সিআরবি’কে রক্ষা করা। সিআরবি-সহ সকল প্রকৃতি রক্ষা পাক; ক্ষয়িষ্ণুপ্রায় মানবিক মূল্যবোধ, প্রগতিশীল চিন্তাভাবনা, ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দেশের মানুষের কল্যাণে সদা জাগ্রত থাকুক- এটাই কামনা। এসব আদর্শের জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন। এগুলো সমুন্নত থাকলে তাঁর বিদেহী আত্মা শান্তি পাবে।
ড. আলা উদ্দিন: অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ([email protected])।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।