অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল: আজ ২৩ জুন উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯৪৯ সালের এই দিনে ঢাকার কে এম দাস লেনে ঐতিহাসিক রোজ গার্ডেনে প্রতিষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম আওয়ামী লীগ। কারাগারে বন্দী অবস্থায় দলটির প্রথম যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন শেখ মুজিবুর রহমান। এর মাত্র দু’বছর আগে দ্বি-জাতি তত্তে¡র ভিত্তিতে বিভক্ত হয় ভারতীয় উপমহাদেশ। ‘হাত মে বিড়ি মু মে পান লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ শ্লোগান মুখে ঢাকার রাজপথ দাপিয়ে-কাঁপিয়ে পাকিস্তান আন্দোলনের সামনের সাড়িতে ছিল এদেশের মানুষ। কিন্তু পাকিস্তান যে মুক্তি নয়, বরং পরাধীনতার নামান্তর মাত্র, বাঙালীর সত্ত্বায় এই উপলব্ধি প্রথমবারের মত জাগ্রত করেছিল এই দলটি।
দুই.
১৯৫৫ সালে দলটির জাতীয় কাউন্সিলে দলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। শেখ মুজিবুর রহমান নির্বাচিত হন দলটির সাধারণ সম্পাদক। দ্বি-জাতি তত্ত্বের অসাড়তা প্রমাণ করে অসাম্প্রদায়িকতার নীতিকে গ্রহণ করে নেয় আওয়ামী লীগ এই সম্মেলনটির মধ্য দিয়ে।
তিন.
উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করার প্রতিবাদে ’৫২’র ২১ ফেব্রুয়ারি গণজাগরণ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে দলটি। কারাগারে থেকেও এই জাগরণে অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন তরুণ জননেতা শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মত বাঙালির জন্য একদম নিজের করে একটি জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বীজ বপণের সূচনা রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ’৫২-তে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে।
চার.
’৫৪’র প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের কাছে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে ধরাশায়ী হয় মুসলিম লীগ। তবে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে দুরে রাখা হয় যুক্তফ্রন্টকে। ’৫৬’র ৬ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে অবশেষে একটি কোয়ালিশন মন্ত্রী সভা প্রদেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। ২১ ফেব্রুয়ারি স্বীকৃতি পায় শহীদ দিবস হিসাবে আর বাংলার স্বীকৃতি মেলে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার এই আওয়ামী লীগের হাত ধরেই।
পাঁচ.
সে যাত্রায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল মাত্র ২০টি মাস। পাকিস্তান জুড়ে মার্শাল’ল জারি করেন জেনারেল আইয়ুব খান। আইয়ুব শাহীর বিরুদ্ধে গণতন্ত্র পুনঃ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয় আওয়ামী লীগ আর পাশাপাশি ’৬২ আর ’৬৪’র শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৪-তে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধ, ’৬৬’র ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলন ’৬৮’র আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা আর ’৬৯’র গণ-অভ্যুত্থানের পথ বেয়ে বাঙালি জাতিকে স্বাধিকারের জন্য প্রস্তুত করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এরই ধারাবাহিকতায় ’৭০’র জাতীয় নির্বাচনে একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতার দাবিদার হয়ে ওঠে আওয়ামী লীগ।
ছয়.
২৫ মার্চের গণহত্যার প্রেক্ষাপটে ’৭১’র ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অবশ্য তারও আগে ৭ মার্চ রেসকোর্সের ঐতিহাসিক জনসভায় আসন্ন সংগ্রামকে মুক্তির সংগ্রাম হিসেবে চিহ্নিত করে তিনি সবাইকে হাতের কাছে যা কিছু আছে তাই নিয়ে মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
সাত.
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে শুরু হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র অধ্যায়টি। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের মুজিবনগরে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্র প্রধান করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত হয় বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীন সরকার। বঙ্গবন্ধু নির্বাচিত হন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি। নয় মাসব্যাপি মুক্তিযুদ্ধ সফলভাবে পরিচালনা করেন এই আওয়ামী লীগ সরকার। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় বাংলাদেশ-ভারত যৌথ সেনা কমান্ডের কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের পর, পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন ও নয়া দিল্লী হয়ে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ দেশে ফিরেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। হাল ধরেন যুদ্ধ বিদ্ধস্ত দেশ পুনর্গঠনের। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে বাংলাদেশ যখন সামনে এগিয়ে যাচ্ছিল, ঠিক সেই সময়টায় স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি ও তাদের বিদেশী প্রভুদের চক্রান্তে ’৭৫’র ১৫ আগস্ট সপরিবারে শাহাদাত বরণ করেন বঙ্গবন্ধু।
আট.
বাংলাদেশের এর পরের ইতিহাস শুধুই পিছিয়ে চলার। এ সময় জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতার পরাজিত শক্তির প্রতি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা আর অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা দমন আর নির্মুলের যে বিষাক্ত পরিবেশ তৈরি হয় সেখান থেকে বাঙালি আর বাংলাদেশকে মুক্তি দিতে শরণার্থী জীবনের অবসান ঘটিয়ে ’৮১’র ১৭ মে দেশে ফিরে আসেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে স্বৈরাচার বিরোধী দীর্ঘ আন্দোলনের পথ বেয়ে ’৯১-এ অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় নির্বাচন। আপাতঃ নিরপেক্ষ নির্বাচনে ছিনতাই হয়ে যায় জনগণের ম্যান্ডেট। ক্ষমতার বাইরেই থেকে যায় আওয়ামী লীগ। দীর্ঘ ২১ বছর পর ’৯৬-এ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশে গঠিত হয় আরেকটি আওয়ামী লীগ সরকার। তবে এবারেও স্থায়ীত্বকাল একটি মাত্র মেয়াদ এবং এর কারণ দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারী আর স্বাধীনতা বিরোধী চক্রের শতমুখী চক্রান্ত।
নয়.
আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশের সুদিন ফেরে ২০০৯-এর জানুয়ারি মাসে যেদিন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতায় ফেরে আওয়ামী লীগ। তবে এই ফিরে আসাটা আদৌ সহজ ছিল না। অসংখ্যবার প্রাণনাশের চেষ্টা করা হয় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার। নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন আওয়ামী লীগের সাংসদসহ শীর্ষ নেতৃত্ব। কিন্তু জনগণের ম্যান্ডেটে এরপর থেকে টানা ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। বিডিআর বিদ্রোহ, আগুন সন্ত্রাস আর এমনি হাজারো প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে নিরবিচ্ছিন্ন ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ আর তার সুফল পাচ্ছে বাংলাদেশ আর বাংলাদেশের জনগণ। এমনকি এই করোনাকালেও সারা বিশ্বের রোলমডেল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশ।
দশ.
এদেশের মানুষকে আওয়ামী লীগ দিয়েছে অনেক কিছুই। এই লেখার পরিসরে তার বিস্তারিত বর্ণনা এক কথায় অসম্ভব। তবে এক কথায় যদি প্রকাশ করতে বলা হয় তবে চোখ বন্ধ করেই বলে দেয়া যায় বাঙালির জন্য আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় উপহার তিনটি- জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, স্বাধীন বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের কনসেপ্ট থেকে স্বাধীনতা আর তলাবিহীন ঝুড়ির বাংলাদেশ থেকে আজকের বাংলাদেশে এর উত্তরণ, এর সবটুকুই আওয়ামী লীগের কল্যাণে। সেই বাংলাদেশের সুবর্ণ জয়ন্তীতে আওয়ামী লীগের ’৭২তম জন্মদিনে ঐতিহ্যবাহী এই রাজনৈতিক দলটির জন্য বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির জন্মদিনের সবচাইতে যথাযথ উপহারটি হতে পারে বাংলাদেশের ‘জাতীয় রাজনৈতিক দল’ হিসেবে আওয়ামী লীগের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি।
লেখক : চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।