দুর্নীতির বিষ বৃক্ষ তার ডালপালা আর শেকড় এমনভাবে গোটা দেশে ছড়িয়েছে যে, এই করোনা মহামারিতেও দুর্নীতির মহাযজ্ঞ থেমে নেই। উন্নয়ন কাজে নিয়োজিত বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন কাজের ঠিকাদারি, সরবরাহ, কেনাকাটা, ইত্যাদি যাবতীয় কাজেই বিএনপি- জামায়াত ঘরানার লোকেদের একছত্র আধিপত্যের বাজার জমে উঠেছে। তাতে এক শ্রেণীর আমলারা মহাখুশি। কারণ তাঁদের জন্য কানাডার বেগম পাড়ার মত উন্নত দেশে বিভিন্ন পাড়া গড়ে উঠছে রাতারাতি।
কেন সরকারী বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের ঠিকাদারি আর কেনাকাটা ও সরবরাহে বিএনপি-জামায়াত ঘরানার আমলা, ঠিকাদার, সরবরাহকারীগন প্রাধান্য পান তার ব্যাপারে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। বিএনপি জামায়াত ঘরানার একাধিক ঠিকাদার, সরবরাহকারীদের একটার পর একটা বড় বড় কাজ পাওয়া দেখে তাঁদের সাথে এবং সরকারী দপ্তরের উন্নয়ন কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত আমলাদের সহযোগীদের সাথে যোগাযোগ করে এই তথ্য পাওয়া যায়।
আওয়ামী ঘরানার সেই সব ঠিকাদার কাজ পান যাদের সাথে মন্ত্রী বা সরকারী দলের বড় বড় নেতাদের খুব ভালো যোগাযোগ আছে। নিজেদের পদোন্নতি, ভালো পোস্টিং এ ব্যবহার করার জন্য তাঁদের কিছু কাজ দেওয়া হয় যা আদতে একটা লেনদেনের মত ব্যাপার। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ করা অনেক ব্যবসায়ীকে ঠিকাদারকে বিএনপি জামায়াত ঘরানার ঠিকাদার বা সরবরাহকারীদের সাইটে সাব কনট্রাক্টর হিসেবে সারা দেশে কাজ করা এখন ভুরু-ভুরি। এদের কাজ না পাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে তার টেবিলের নীচ দিয়ে দেওয়া খামের ওজন কম দেয় বা বড় কাউকে বলে দিতে পারে এই শংকা থাকে কাজ দেওয়ার ক্ষমতা থাকা আমলাদের মনে। কারণ এমন একাধিক ঘটনা ঘটেছে। ক্ষমতাসীন দলের ব্যবসায়ী নেতা কর্মীরা সব জায়গায় ক্ষমতা দেখাতে চান, এমন ধারণা সবার মাঝে বদ্ধমূল।
অন্যদিকে বিএনপি জামায়াত ঘরানার বা পদ বাণিজ্যের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের পদ পাওয়া ঠিকাদার বা সরবরাহকারীগন খুব নম্র ভদ্র হয়ে কথা বলেন, তাঁদের দেওয়া খামের ওজন অনেক বেশি, কোন বারগেনিং করেন না। তারা তাঁদের পুরাতন সাথী আমলাদের সাথে আন্তরিকতার সাথে দেশে বিদেশে যেখানে দরকার নিরাপদে খাম পাঠান।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, টেন্ডার কেলেঙ্কারি হোতা জিকে শামীম, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালক ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়া; কেউই আসলে আওয়ামী লীগের লোক না। পদ বাণিজ্যের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সাজা মানুষ তাই তারা বড় বড় কাজের দায়িত্ব পান। তাঁদের কারো কারো লাভের একটা বড় অংশ বিদেশে পালিয়ে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের কাছে পাঠানো হতো। ঢাকা থেকে খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও জি কে শামীমের বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট থেকে, কখনও হুন্ডির মাধ্যমে প্রথমে ওমানের মাসকট ব্যাংকে টাকাগুলো জমা হতো। এরপর সেখানে থাকা আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী নাদিমের দায়িত্ব ছিল টাকা তুলে জার্মানিতে থাকা জিসানের কাছে পাঠানো। মাঝেমধ্যে সম্রাটের ইচ্ছায় সিঙ্গাপুর হয়েও জিসান অবধি পৌঁছাতো সে টাকা। পদ বাণিজ্যের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ হওয়া পুরানো ঢাকার গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এনামুল হক এনু ও সহসাধারণ সম্পাদক রুপন ভূঁইয়ার অঢেল সম্পদের মালিক বনেছেন একই তরিকায়।
এবার আসি ত্রাণ বিতরণের একটা উদাহরণে। ৩শ জনের নামের বিপরীতে ৪টি মোবাইল নম্বর দেওয়ার সমালোচিত হবিগঞ্জের চেয়ারম্যান আসলে যুবদল থেকে আওয়ামী লীগের এমপি আবু জাহিরের হাত ধরে ২০১৬ আওয়ামী লীগে যোগ দেয়। তাই তার লগ্নি করা টাকা তুলতে এই চুরুর চেষ্টা করে সরকারের বদনাম করে সে।
দেখে নেওয়া যাক, সরকারি অফিসের আমলাদের দুই একটি তথ্য নিয়ে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ইঞ্জিনিয়ার বলেন যে, যারা ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউট অফ বাংলাদেশে সারা জীবন বিএনপি প্যানেলে নির্বচন করেছেন এমন অনেকেই এখন বড় আওয়ামী ঘরানার ইঞ্জিনিয়ার। তাঁদের অধিকাংশই বিভিন্ন প্রকল্পের পিডি বা প্রকল্প পরিচালক। তাঁদের রুমে ঢুকলে মনে হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কোনো অফিসে এসেছেন। কিন্তু তাঁদের সামনের সারিতে বসে থাকে পদ বাণিজ্যের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ হওয়া ঠিকাদার, সরবরাহকারী বা বিএনপি ঘরানার মাঝারী গোছের ব্যবসায়ী। ত্যাগী আওয়ামী ঘরানার কোন কেউ গেলে তাঁকে হাই কোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট দেখানো হয়। রূপপুরের বালিশ কেলেঙ্কারির মত এমন ঘটনা ভুরি ভুরি, তা কোন মিডিয়া প্রকাশ করতে চাইলেই সেখানে বড় ঠিকাদার বা সরবরাহকারী মোটা অংকের টাকার বিজ্ঞাপন পাঠান।
সম্প্রতি বিভিন্ন মিডিয়া ও একটি জনপ্রিয় পোর্টালে প্রমাণ সহ দেখিয়েছে যে, ছাত্র দল করা ড্যাব নেতা কিভাবে এই করোনা কালে সরকারি টাকা তসরুপ করেছেন, তাঁকে এই টাকা তসরুপের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এ পোর্টালের অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। ছাত্রদলের একজন সাবেক ক্যাডার ও ড্যাব নেতার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে করোনা মোকাবেলার সমস্ত দায়িত্ব। আর সেই ড্যাব নেতাই করোনা মোকাবেলায় নিজের ইচ্ছামতো কেনাকাটা করছেন। যে কেনাকাটাগুলো ‘বালিশ কেলেঙ্কারি’কেও হার মানিয়ে দিয়েছে। শুধু পিপিই বা অন্যান্য সামগ্রী নয়, ডিজিটাল বাংলাদেশে সফটওয়্যার কিনতে গিয়েও এই ড্যাব নেতা যে মূল্য প্রাক্কলন করেছেন, তা ভয়াবহ।
অনুসন্ধানে প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, ৪টি ওয়েবসাইট উন্নয়নের খরচের জন্য ধরা হয়েছে ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ৫টি ডাটাবেজ তৈরির খরচ ধরা হয়েছে ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ৫টি কম্পিউটার সফটওয়্যারের জন্য ধরা হয়েছে ৫৫ কোটি টাকা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ডা. মো. ইকবাল কবীর এখন ৪টি দায়িত্ব পালন করছেন। প্রথমত তিনি পরিচালক (পরিকল্পনা) হিসেবে কাজ করছেন। তারপর তিনি লাইন ডিরেক্টর (পরিকল্পনা), বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় ১ হাজার ৩৫০ কোটি টাকার ইমার্জেন্সি কোভিড রেসপন্স প্রকল্পের প্রকল্প প্রধান। এই প্রকল্পের কেনাকাটায় যে মূল্য ধরা হয়েছে সেই মূল্যগুলো ‘বালিশ কেলেঙ্কারি’কেও লজ্জায় ফেলবে। শুধু এখানেই শেষ নয়, ডা. মো. ইকবাল কবীরকে এডিবির অর্থ সহায়তায় ‘টেকনিক্যাল অ্যাসিস্টেন্স প্রজেক্ট অন কোভিড-১৯’ এর প্রকল্প প্রধানও করা হয়েছে। এটি প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার প্রকল্প। এখানে এডিবির ৮৫০ কোটি টাকার অর্থায়ন রয়েছে। এছাড়া বাকি অর্থায়ন করবে বাংলাদেশ সরকার। যারা ডা. মো. ইকবাল কবীরকে দায়িত্ব দিয়েছেন, তারা কি কন স্বার্থ ছাড়াই এমন করেছেন, নাকি অন্য কাহিনী আছে। তা না হলে ডা. মো. ইকবাল কবীরের মত যোগ্য কন লোক ডিজি হেলথ অফিসে নেই!
উল্লেখিত কারণের মত একাধিক কারণে একাধিক বিএনপি জামায়াত ঘরানার বা পদ বাণিজ্যের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের পদ পাওয়া ঠিকাদার বা সরবরাহকারীগন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের মত করে চান যে, আওয়ামী লীগ আরও ক্ষমতায় থাক। ইতোমধ্যে তারা টাকা কামিয়ে নিয়ে মাঝে মাঝে লন্ডনে পাঠাচ্ছেন, সব শেষে দরকার হলে নমিনেশন কিনে নেবেন লন্ডন গিয়ে। কিংবা যদি আওয়ামী লীগেও বা ১৪ দলে নমিনেশন বাণিজ্য হয়ে সেই সুযোগ কাজে লাগাবেন তাঁরা। বাংলাদেশে এখন টাকায় কী না হয়! কুয়েতের গোয়েন্দাদের হাতে আটক স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচিত সংসদ সদস্য শহীদ ইসলাম পাপুল আর তার স্ত্রী সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য (এমপি) হয়েছে কী রাজনীতি করে না টাকার জোরে!
সাইদুল আরেফিন, বাংলা ইনসাইডার
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।