আন্তর্জাতিক ডেস্ক : এই সেই হেনরি কিসিঞ্জার। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন। গালিগালাজ করেছিলেন ভারতীয়দের। সেই কিসিঞ্জারের সঙ্গেই গত মঙ্গলবার রাতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে দেখা গেছে।
তার অফিশিয়াল টুইটার হ্যান্ডল থেকে পোস্ট করা ছবিটা অনেককেই চমকে দিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের লনে পাশাপাশি বসে নরেন্দ্র মোদি ও কিসিঞ্জার। ৯৬ বছরের বৃদ্ধ কিসিঞ্জার সজোরে চেপে ধরে আছেন মোদির হাত। একটু ঝুঁকে পড়ে দুজনে গভীর মনোযোগে কোনো কথাবার্তা বলছেন।
দিল্লিতে সাত নম্বর জনকল্যাণ মার্গের বাংলোতে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া পার্টিতেই সে রাতে অন্যতম অতিথি ছিলেন কিসিঞ্জার, যিনি এত বয়সেও ভারতে এসেছিল।
জেপি মর্গ্যান ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিলের বৈঠকে যোগ দিতে। সেই ছবি টুইট করে নরেন্দ্র মোদি লেখেন, ‘ড: হেনরি কিসিঞ্জারের সঙ্গে দেখা করে আনন্দিত বোধ করছি। আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও কূটনীতিতে তার অবদান একজন পথিকৃতের!’
এই সেই হেনরি কিসিঞ্জার – মার্কিন কূটনীতিক ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে যার প্রবল ভারতবিরোধী ভূমিকার কথা কারও অজানা নয়। কুখ্যাত ‘নিক্সন টেপে’ তো হেনরি কিসিঞ্জারকে বলতে শোনা গিয়েছিল ভারতীয়রা ‘সাচ বাস্টার্ডস’ (এত বড় বেজম্মা), আর ইন্দিরা গান্ধী একজন ‘বিচ’!
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের চালানো গণহত্যাকেও প্রচ্ছন্ন সমর্থন করে স্বাধীন বাংলাদেশেও তার পরিচয় এক নিন্দিত চরিত্রের। আর সেই বাংলাদেশকেই একদা ‘বটমলেস বাস্কেট’ বা ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে কিসিঞ্জারের বর্ণনা তো প্রায় লোকগাথায় পরিণত!
কাম্বোডিয়ায় বেআইনিভাবে বোমা ফেলে গণহত্যা থেকে চিলিতে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে উৎখাত – এমন বহু ঘটনায় বারে বারে নাম জড়িয়েছে কিসিঞ্জারের। শীতল যুদ্ধের সময়কার ‘রিয়ালপলিটিকে’র মূর্ত প্রতীক বলেও তাকে মনে করেন অনেকেই।
এমন দুষ্ট প্রকৃতির লোক হেনরি কিসিঞ্জারের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর অন্তরঙ্গতার ছবি তাই অনেকেরই চোখ কপালে না তুলে পারেনি। শীতল যুদ্ধের পর্বে ভারতের কূটনীতিকের দায়িত্ব পালন করা দেব মুখার্জি বলেন, ‘রাজনীতি আর কূটনীতিতে যে আসলে সবই সম্ভব, এই ছবিটা বোধহয় তার প্রমাণ।’
তিনি বলেন, ‘ছবিটা সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট করার সময় প্রধানমন্ত্রী কিসিঞ্জারের পুরনো ইতিহাস, ভারতের সঙ্গে তার সম্পর্ক – এগুলো আদৌ মনে রেখেছেন বলে তো মনে হয় না! হেনরি কিসিঞ্জারের একটা সাঙ্ঘাতিক বাজে ইমেজ আছে। সেটাও কিন্তু অস্বীকার করা যাবে না। আর তিনি যা করেছেন, আমেরিকার জাতীয় স্বার্থেই করেছেন এই যুক্তিটাও তার পক্ষে দেওয়া যায়। হতে পারে, আন্তর্জাতিক কূটনীতির চাণক্য হিসেবে সম্মান তিনি অর্জন করেছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রীও সেই সমীহটুকুই হয়তো তাকে দিয়েছেন। এর বেশি কিছু নয়!’
অবশ্য প্রবীণ এই সাবেক কূটনীতিক নরেন্দ্র মোদিকে কিছুটা ‘বেনিফিট অব ডাউট’ দিতে রাজি। অন্যদিকে ঢাকায় পররাষ্ট্রনীতির বিশেষজ্ঞ ইমতিয়াজ আহমেদ আবার মনে করেন, এ থেকে বোঝা যায় নরেন্দ্র মোদি বা ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো রাজনীতিকরা ‘মিডিয়া অ্যাটেনশনকে’ই আসলে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন। তার মতে, ‘মানুষ কী ভাবল না-ভাবল, আবহমান কাল ধরে একটা দেশ কী নীতি অনুসরণ করে আসছে – সেগুলোর চেয়ে এই নেতাদের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল মিডিয়া কীভাবে তাদের তুলে ধরছে, বা সোশ্যাল মিডিয়াতে তারা নিজেদের কীভাবে তুলে ধরতে পারছেন!’
তিনি আরও মনে করেন, গত মাসেই টেক্সাসে গিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রনীতির তোয়াক্কা না করে নরেন্দ্র মোদি যেভাবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের হয়ে নির্বাচনী প্রচার করে এসেছেন; কিসিঞ্জারের সঙ্গে ছবিতেও তার সেই ড্যাম কেয়ার মনোভাবই প্রতিফলিত হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ যে একাত্তরে তার ভূমিকার জন্য হেনরি কিসিঞ্জারকে আজও ক্ষমা করতে পারেনি, সে কথা জানিয়ে ইমতিয়াজ আহমেদ আরও বলেন, ‘আজ এই দেশ অর্থনীতিতে কতটা উন্নতি করেছে, সেটা বোঝাতেও বারবার টেনে আনা হয় কিসিঞ্জারের সেই বটমলেস বাস্কেটের উপমা। ফলে তিনি চাইলেও বাংলাদেশ তাকে আজও ভুলতে পারে না।’
ঘটনা হলো, নরেন্দ্র মোদির বাড়ির লনে আয়োজিত যে পার্টিতে হেনরি কিসিঞ্জার ছিলেন, সেখানে আরও ছিলেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টোনি ব্লেয়ার, সাবেক মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা কন্ডোলিজা রাইস, সাবেক অস্ট্রেলিয়ান প্রধানমন্ত্রী জন হাওয়ার্ড এবং সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট গেটসও। ব্রিটেনের ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকা এক নিবন্ধে এই সমাবেশকেই কটাক্ষ করে বলেছে ‘যুদ্ধবাজ নেতারা : আধুনিক সব সংঘাতের স্থপতিরা যখন ক্যামেরার সামনে হাসিমুখে!’
হেনরি কিসিঞ্জার তো আছেনই – নরেন্দ্র মোদির টুইট করা আর একটি ছবিতে হাসিমুখে তাদের সাথে দেখা যাচ্ছে ব্লেয়ার-রাইস-হাওয়ার্ড-গেটসকেও, যাদের সবাই কুখ্যাত ইরাক যুদ্ধের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িত ছিলেন। গার্ডিয়ানে ওই নিবন্ধটির লেখক জুলিয়ান বোর্গার লিখছেন, ‘এই ব্লেয়ার বা কন্ডোলিজা রাইসরাই যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন গুজরাটে মুসলিম-বিরোধী দাঙ্গায় হাজার মানুষ নিহত হওয়ার পর তাদের দেশের সরকারগুলো মোদিকে বিলেত-আমেরিকায় ভিসা দিতে অস্বীকার করেছিল। এখন দেখে মনে হচ্ছে সেসব আপাতদৃষ্টিতে ক্ষমা করে দিয়েছেন!’
অথচ এই হেনরি কিসিঞ্জারই পাকিস্তানের সেই স্বৈর-শাসকদের নিরন্তর সমর্থন করে গেছেন, যারা সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে অন্তত তিরিশ লক্ষ মানুষের নির্মম গণহত্যার জন্য দায়ী। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সেই গণহত্যা নিয়ে লেখা ‘ব্লাড টেলিগ্রাম’ বইয়ের লেখক গ্যারি বাসও কটাক্ষের সুরে বলেছেন, ‘অথচ মোদি যদি কিসিঞ্জিারের ওপর রুষ্ট হতে চাইতেন, তার কাছে কিন্তু রসদের অভাব ছিল না!’ ভারতের ‘স্ক্রোল’ পোর্টাল লিখেছে, ১৯৭১ সালের জুলাইতে এই কিসিঞ্জারই যখন ভারত সফরে আসেন, সে সময়কার ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম তাকে মুখের ওপর স্পষ্ট বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান এতটা বাড়াবাড়ি করার সাহস পাচ্ছে স্রেফ আপনাদের জন্য।’ সূত্র : বিবিসি
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।