শরীফ উল্যাহ: এক ভদ্রলোকের মুখে মাস্ক নেই। হুড়মুড় করে আমার অফিসে ঢুকে পড়লেন। অফিসের লোকজনকে তার জমিজমা সংক্রান্ত কী একটা বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতেছিলেন। এমন সময় আমার এক অফিস সহকারী বললেন, ‘ভাই, আপনি মাস্ক ব্যবহার করছেন না কেন? বাহিরে গিয়ে মাস্ক পরে আসুন। তারপর আমরা আপনার বিষয়টি দেখবো।’
এভাবে বলাতে ভদ্রলোক খুবই মাইন্ড করলেন। হঠাৎ তেলেবেগুনে গরম হয়ে গেলেন। চেঁচামেচি করতে লাগলেন। মাস্ক না পরলে কি সেবা দিবেন না? আমি সুস্থ মানুষ। আমি অসুস্থ নই, ইত্যাদি নানান কথা উচ্চস্বরে বলতে লাগলেন। কয়েকটি কথা আমার কানে আসার পর, ভদ্রলোককে আমার রুমে ডেকে এনে সুন্দর করে বুঝানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু তিনি তার কথায় অনড় থাকতে চাইলেন। বললেন, ‘আমাকে এভাবে বললো কেন? মাস্ক না পরায় কি বড় অপরাধ হয়ে গেছে? অন্য কেউ কি মাস্ক ছাড়া অফিসে আসে না।’ যাই হোক, পরে তার কণ্ঠস্বর কিছুটা নিচু হয়েছে।
আমার অফিসে প্রতিদিন বিভিন্ন কাজে অনেক মানুষ আসেন। আমার সাথে অনেকেই সামনাসামনি কথা বলেন। বিভিন্ন মামলার শুনানিকালে অনেক মানুষকে শুনতে হয়। কিছু মানুষকে পেয়ে থাকি যারা অফিসে বা আমার কক্ষে ঢুকার সময় মাস্ক পরেই ঢুকেন। কিন্তু পরিচয় দেওয়ার জন্য কিংবা কথা বলার সময় অনেকেই মাস্ক খুলে ফেলেন। তখন বাধ্য হয়েই মাস্ক পরার জন্য অনেককে বলতে হয়। এতে দেখা যায়, কিছু মানুষ মন খারাপ করে ফেলেন। হয়তো কারো কারো ইগোতে লাগে। হয়তো অপমানিত বোধ করেন!
আমাদের দেশের এক শ্রেণির মানুষের এতদিনে মাস্ক পরার অভ্যাস অনেকটা গড়ে উঠেছে। এরা নিয়মিত এবং সুন্দরভাবেই মাস্ক পরে থাকেন। পরিবেশ-পরিস্থিতি বুঝে এরা মাস্কের ব্যবহার সঠিকভাবেই করে থাকেন। বলা যায়, এরা সচেতন শ্রেণি। আরেকটা শ্রেণি লোক দেখানো নীতিতে মাস্ক পরেন, ম্যাজিস্ট্রেট বা পুলিশ দেখলে মাস্ক পরেন অর্থাৎ এরা মাঝে মাঝে মাস্ক পরেন, আবার মাঝে মাঝে খুলে ফেলেন। কেউ কেউ মাস্ক কানে লটকিয়ে থুতনি ঢেকে রাখেন। নাক-মুখ খোলাই থাকে। অথচ মাস্ক লাগানোর উদ্দেশ্যই হচ্ছে নাক-মুখ ঢেকে রাখা। যাতে শরীরে ভাইরাস প্রবেশ করতে না পারে। অনেকে মাস্ক হাতে নিয়ে, পকেটে নিয়ে কিংবা ব্যাগে নিয়ে হাঁটেন। কোথাও পরতে বাধ্য করা হলে যাতে পরতে পারেন। এই শ্রেণি অনেকটা অসচেতন; অবচেতন। তবে এরা নিজেরা যেমন ঝুঁকির মধ্যে থাকেন তেমনি অন্যের জন্যও হুমকিস্বরূপ।
আমি এবিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত নই যে, মাস্ক পরলে কিংবা সঠিকভাবে মাস্ক পরলেই কোনো মানুষ করোনায় আক্রান্ত হবেন না। নিয়মিত মাস্ক ব্যবহার করার পরও কিছু মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন, জেনেছি। যেহেতু বিভিন্ন মাধ্যমে একজন মানুষ করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে সেহেতু মাস্ক পরার পরেও একজন মানুষ আক্রান্ত হতেই পারেন। তবে বিশেষজ্ঞরা এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাস প্রতিরোধে নিয়মিত মাস্ক ব্যবহার করা, সামজিক দূরত্ব বজায় রাখা, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা বা কিছুক্ষণ পর পর হাত ধৌত করা ইত্যাদি কিছু বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। তাই মাস্ক পরার বিষয়ে সচেতন না হয়ে উপায় নেই।
এটাও বাস্তব সত্য যে, আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষেরই দামি মাস্ক দূরের কথা, প্রতিদিন নতুন নতুন মাস্ক পরা কিংবা ঘনঘন মাস্ক বদলানোর সামর্থ্য নেই। তবে অনেক সামর্থ্যবানকেও আমি দেখেছি, একটি সার্জিক্যাল বা কাপড়ের মাস্ক পরতে পরতে ময়লা জমিয়ে কালো করে ফেলেছেন বা পরতে পরতে ছিঁড়ে ফেলেছেন। এই মাত্রার স্বাস্থসচেতনতা খুবই দুঃখজনক। যাদের সামর্থ্যের অভাব রয়েছে তাদেরকে কাপড়ের মাস্ক পরতেও উৎসাহিত করা হচ্ছে। তারা নিয়মিত ধুয়ে কাপড়ের মাস্ক ব্যবহার করতে পারেন।
তবে বর্তমান বাস্তবতায়, মাস্ক পরার ক্ষেত্রে উদাসীন হবার সুযোগ নেই। একটা বিষয় আমাদেরকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে যে, বাহিরে বের হলেই আমরা বিভিন্ন কাজে বিভিন্ন জায়গায় যাই, বিভিন্ন মানুষজনের সাথে মিশি, কথা বলি, দোকানে যাই, কাঁচাবাজার-মাছবাজারে যাই, সুপারশপে যাই। কেনাকাটা করি। বিভিন্ন অফিসে যাই। অনেক যানবাহনে চড়ি। হাসপাতালে যাই। লিফটে চড়ি, ইত্যাদি নানান কাজে আমাদেরকে প্রতিদিন বের হতে হয়। এইসময়ে আমরা যদি আবশ্যিকভাবে মাস্ক ব্যবহার না করি তাহলে এটি আমাদের জন্য অনেক বড় বিপদের কারণ হতে পারে এবং আমরা নিজের অজান্তেই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ভাইরাসটি বহন করে ঘরে এনে পরিবারের সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারি এবং যত জায়গায় যাবো সব জায়গায় তা ছড়াতে পারি!
বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে দেখেছি, কিছু মানুষ ঈদের মার্কেটে মাস্ক না পরেই কেনাকাটা করতে যান। অথচ জিজ্ঞাসা করলেই, নানান শ্রুতিকটু জবাব দেন। ক্ষেপে যান। এসব কেমন চিন্তা? কেমন সচেতনতা? আগে জানতাম, করোনা আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে এলে কিংবা করোনা আক্রান্ত রোগীর হাঁচি-কাশি থেকে নির্গত ড্রপলেট থেকে করোনা ভাইরাস ছড়ায়। কিন্তু ইদানীং শুনছি, বাতাসের মাধ্যমেও নাকি করোনাভাইরাস ছড়ায়। সুতরাং মারাত্মক এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে প্রতিটি মানুষের জীবন কতটা ভয়াবহ ঝুঁকিতে রয়েছে, তা প্রতিদিনের বৈশ্বিক পরিসংখ্যান থেকে সহজেই বুঝা যায়।
একথা এখন নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, জনগণের অতিমাত্রার উদাসীনতা আর অবহেলার কারণেই আমাদের দেশে বর্তমানে করোনা সংক্রমণ দিনদিন ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং মৃত্যুর সংখ্যাও আশংকাজনক হারে বাড়ছে। তাই এখন মাস্ক পরাসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে আমাদের আর উদাসীনতা দেখানোর সুযোগ নেই। আমাদের মানসিকতা বদলাতে হবে। প্রয়োজনে অভ্যাস বদলাতে হবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে হবে। করোনা আক্রান্ত পৃথিবীতে আমরা এখন এক কঠিন যুদ্ধের ময়দানে! হাতিয়ার ছাড়া যুদ্ধে নেমে যুদ্ধজয় কি সম্ভব? এক্ষেত্রে ব্যক্তিসচেতনতাই সবচেয়ে বড় হাতিয়ার বলে আমার বিশ্বাস। তাই, আসুন, আমরা নিজেরা সচেতন হই। অন্যদেরকেও সচেতন করি। নিয়মিত মাস্ক ব্যবহার করি। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখি ও অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি।
লেখক: সিনিয়র সহকারী কমিশনার (ভূমি), হাটহাজারী উপজেলা, চট্টগ্রাম।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।