মাশরুর ইমতিয়াজ: আবরারের মৃত্যু আমাকে ব্যথিত করে না। এমনকি বিচার চাই, এমনটাও বলার কোনো ইচ্ছে নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররাজনীতির নামে যা চলে সেটা হচ্ছে প্রথম বর্ষের ঢাকার বাইরে আসা একদম বাচ্চা বাচ্চা ছেলেগুলোকে নিয়ে ক্যাম্পাস-শোডাউন যাকে বলা হয় মিছিল, গেস্টরুমের খবরদারি এবং হুমকিধমকি, যাকে বলা হয় ‘ম্যানার শেখানো’ এবং ‘সাধারণ তথা নন-পলিটিক্যাল’ ছাত্রদের উপরে রাজনৈতিক ‘ভাই’দের সরাসরি কর্তৃত্ববাদী আচরণ।
এইরকম জীবনযাপনের ফলে এই ছেলেমেয়েগুলোর অধিকাংশ হয়ে যায় মেরুদণ্ডহীন ‘সহমত ভাই’। এদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন পার হয়ে যায় চোথা পড়ে, পরীক্ষায় পাশ করে- এভাবেই কোনোমতে ক্যাম্পাস পার হয়ে যাওয়া। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সৌন্দর্য, দ্বিমত রাখা, প্রশ্ন তোলা, বুদ্ধিবৃত্তিক আলাপ- এইসবের দূরতম স্পর্শও না থাকায় এরা মানসিকভাবে অনেকটাই মৃত হয়ে যায়। এইসব মৃত্যুর হিসাবও থাকে না কোনো খাতায়।
এর বাইরে যারা ক্ষমতার বলয়ের কেন্দ্রের হলের ‘ভাই’ হয়ে যায়। ক্ষমতার স্বাদসহ এদের চোখে সার্বক্ষণিক থাকে সানগ্লাস, পরনে টাক-ইন শার্ট, হাতে দামি মোবাইল, ঝাঁ চকচকে বাইক আর পেছনে জম্বির মত চলা সহমত ভাইদের একটা দল। যারা জানেও না কেন, কিসের জন্য, কীভাবে তারা হাঁটছে। এই ভাইদের নির্দেশের কোনো রকম বিবেচনাবোধ থেকে ঝাপিয়ে পড়া যায় আবরারদের ওপর।
আবরারের মৃত্যু সংবাদ আসায় ফেসবুক উত্তাল হলো, নৈমিত্তিক সাধারণ পেটানি বা ধমকানি তো খবরের আড়ালেই থাকে। এই মৃত্যু, এমন সব মৃত্যু একবারে, একদিনে ঘটে না। হল বা ক্যাম্পাসে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ভয়ের সংস্কৃতির টিকিয়ে রাখা ক্ষমতাধর ছাত্রসংগঠনের বেপরোয়া আর নির্দয় হাতেই এমন সব মৃত্যু আর মারধর, চলমান একটা বিশাল ঘটতে থাকা ঘটনা। যে কারণে শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়েছে সম্প্রতি। বুঝে উঠি না, কেন এতো দীর্ঘদিন ধরে বেড়ে ওঠা এসব নেতা, ক্ষমতাধরদের লালন করা হলো? যা হচ্ছে এসব অন্যায় বলে কেন শুরুতেই থামিয়ে দেয়া হয়নি? নিজের ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে এমন বড় বড় খেলার হিসাব মেলেই না।
কিছুদিন আগে প্রশ্ন ওঠে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী? এখন যদি প্রশ্ন তোলা হয় যে আবাসিক হলগুলোর দায়িত্ব কী? যদি প্রশ্ন তোলা হয়, কেন ক্যাম্পাসে ক্ষমতাসীনদের ছাত্র সংগঠনগুলো এমন দানবের মতো দমবন্ধ করা ভয়ের একটা সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখে? কাদের কাছ থেকে এমন আচরণের প্রশ্রয়টা আসে? এসবের উত্তর জানা আছে সবার। এমনকি যারা এসব করে তারাও এই উত্তর জানে। তাই তৈরি থাকে রেডিমেড জবাব যে এভাবেই ক্যাম্পাসকে রাখতে হয় স্থিতিশীল।
খুবই দুঃখ আর হাসি লাগে যে, এরপরেও মাথা বিকিয়ে দেয়া কিছু ‘গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল’ মানুষের দল ইনিয়ে বিনিয়ে গাইতে থাকে- দানবসুলভ ভাইদের ঐতিহ্যগত গুণগান, তাদের কাছ থেকে তো এমনটা আশা করি না জাতীয় ফেইক রোমান্টিক সংলাপ, এবং ঘুণে ধরা সিস্টেমের অজুহাতের গৌরবকীর্তন। নীরবতাও একধরনের অন্যায় বা কাপুরুষতা, মানলাম! তাই বলে এমন চোখ বন্ধ করে সব ঠিক চলছে বলে দেয়া যায় কীভাবে?
বাংলাদেশের ক্ষুদ্রতম সমস্যাটার সমাধানটাকেও সমাধানকল্পে নজর দিতে হয় রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বোচ্চ দায়িত্বপ্রাপ্ত মানুষটিকে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণসাপেক্ষেই, সামান্যতম সমস্যাটার সমাধান আনতে হয়। দৃষ্টি যদি আকর্ষণ করাই হয়, সেটা হোক ক্ষমতার আশপাশে থাকা সেই মানুষগুলোর জন্য। আর তারা যদি বুঝতো- চাপা দেয়া হস্তক্ষেপে আর ক্ষমতার দাপটে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ক্রমশ পরিণত হচ্ছে অন্ধকার গুমোটঘরে। যে অন্ধঘর থেকে একদম অস্তগামী সময়েও হয়তো বেঁচে থাকার আলোটাও উঠবে না। তবে এও জানা আছে, তারা বুঝবেনও না এবং এভাবেই চলমান থাকবে যা চলছে তাই!
যদি কোনোদিন সত্যিকারের শ্বাস নেয়ার মতো ক্যাম্পাসে হাঁটা যায়, সেইদিন বড়জোর মাফ চেয়ে নেয়া যাবে শের-ই-বাংলা হলের আবরার, অথবা এফ রহমানের আবু বকর, কিংবা এস এম হলের হাফিজুরের কাছে – মাথা নিচু করে।
তাই, আবরারের মৃত্যু আমাকে ব্যথিত করে না।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।