জুমবাংলা ডেস্ক : কক্সবাজার সদর হাসপাতালের মর্গের হিমঘরে ২৫ দিন পড়ে থাকার পর লাকিংমে চাকমার মরদেহ বুঝে পেলেন স্বজনরা। সোমবার (৪ জানুয়ারি) আদালতের নির্দেশে লাকিংমের চাচাতো ভাই ক্যচিং মং চাকমা স্বাক্ষর করে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতাল মর্গের হিমঘর থেকে মরদেহ বুঝে নেন।
এদিন বিকাল সোয়া তিনটায় মামলার দায়িত্বপ্রাপ্ত তদন্ত কর্মকর্তা র্যাব-১৫ কক্সবাজার ব্যাটালিয়ানের উপ-পরিদর্শক (এসআই) অর্জুন চৌধুরীর উপস্থিতিতে মরদেহ হস্তান্তর হয়।
কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) শাহীন মো. আবদুর রহমান চৌধুরী বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
হাসপাতাল চত্বরে উপস্থিত সাংবাদীকদের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র্যাবের উপ-পরিদর্শক অর্জুন চৌধুরী বলেন, ‘তদন্তে লাকিংমে চাকমার বয়স নাবালিকা অর্থাৎ প্রচলিত আইনে বিয়ের উপযুক্ত হয়নি বলে প্রমাণ হয়েছে। তাই লাকিংমের যদি বিয়ে হয়েও থাকে, তা আইনগতভাবে অবৈধ। এজন্য সার্বিক বিবেচনায় ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী শেষকৃত্য সম্পন্ন করতে তার মরদেহ বাবা-মায়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।’
এটি একটি অপহরণ মামলা হিসেবে আদালতে বিচার কার্য চলবে বলে জানান মামলার এ তদন্ত কর্মকর্তা।
এদিকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ হিমঘরের ভাড়া বাবদ ২৪ হাজার টাকা দাবি করায় মরদেহ হস্তান্তরে কিছুটা জটিলতা তৈরি হয়। লাকিংমের পরিবার অসহায় ও দরিদ্র হওয়ায় ওই টাকা পরিশোধ করতে পারেনি। পরে র্যাব-১৫ কক্সবাজারের উপ-অধিনায়ক মেজর মেহেদী হাসান বিষয়টি জানতে পেরে র্যাবের পক্ষ থেকে হিমঘরের ভাড়া পরিশোধ করার ব্যবস্থা করেন। এরপর মরদেহ হস্তান্তর করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) শাহীন মো. আবদুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘‘গত ৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় লাকিংমে চাকমাকে কয়েকজন যুবক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসে। তারা কর্তব্যরত চিকিৎসকদের জানায়, রোগী বিষপান করেছে। তখন কর্তব্যরত চিকিৎসক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে হাসপাতালে আনার আগেই তার মৃত্যু হয়েছে বলে জানায়। বিষয়টি হাসপাতালে কর্মরত পুলিশকে জানানো হয়।
‘পুলিশ লাকিংমের মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে ময়না তদন্তের জন্য মর্গে পাঠায়। ১০ ডিসেম্বর লাকিংমের মরদেহের ময়না তদন্ত সম্পন্ন হয়। এর মধ্যে আতাউল্লাহ নামে এক যুবক লাকিংমেকে নিজের স্ত্রী দাবি করে মরদেহ তাকে হস্তান্তরের জন্য পুলিশকে আবেদন করে। এদিকে মেয়ের অস্বাভাবিক মৃত্যুর খবর পেয়ে বাবা লালা অং হাসপাতালে গিয়ে সন্তানের মরদেহ পাওয়ার আবেদন করেন। শুরু হয় আইনি জটিলতা।
‘১৫ ডিসেম্বর লালা অং চাকমা সন্তানের মরদেহ তাকে হস্তান্তরের জন্য টেকনাফ বিচারিক হাকিম আদালতে আবেদন জানান। আদালত শুনানী শেষে আবেদনটি গ্রহণ করে লাকিংমের ধর্ম পরিচয় নিশ্চিত হয়ে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করার জন্য র্যাবকে দায়িত্ব অর্পন করেন।”
আদিবাসী ফোরাম কক্সবাজার জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মংথেলা রাখাইন বলেন, ‘গত ২৮ ডিসেম্বর মানবাধিকার কর্মীদের একটি দল টেকনাফে লাকিংমে চাকমার বাড়িতে যান। তারা পরিবার, গ্রামবাসী, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও আতাউল্লাহর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন। পরেরদিন দলটি লাকিংমের বাবার উপস্থিতিতে কক্সবাজার র্যাব-১৫ এর কর্মকর্তাদের সঙ্গেও কথা বলেন।’
কক্সবাজারের টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শীলখালীর অরণ্যভরা আদিবাসী গ্রাম চাকমা পাড়ার অসহায় দরিদ্র লালা অং চাকমা।
তিনি বলেন, ‘‘২০২০ সালের ৫ জানুয়ারি লাকিংমেকে একই ইউনিয়নের মাথাভাঙ্গা এলাকার আতাউল্লাহসহ চার-পাঁচ যুবক অপহরণ করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। ঘটনার দিনই অপহরণের বিষয়টি স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য মোহাম্মদ হাফেজকে জানিয়ে আমার মেয়েকে উদ্ধার করতে অনুরোধ করি। কিন্তু ওই ইউপি সদস্য কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
‘প্রতিকার না পেয়ে পরে আমার মেয়েকে বিভিন্ন জায়গায় খুজঁতে থাকি। আতাউল্লাহর স্বজনদের সঙ্গেও দেনদরবার করি। তবুও মেয়েকে ফিরে পাইনি। পরে টেকনাফ থানায় অপহরণ মামলা করতে যাই। কিন্তু টেকনাফ থানায় কর্মরত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ মামলা না দিয়ে আমাকে ফিরিয়ে দেন।
‘পরে ২৭ জানুয়ারি আমি বাদী হয়ে কক্সবাজার জেলা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করি। ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামলাটি তদন্তের জন্য পিবিআইকে আদেশ দেন।”
লালা অং চাকমা মামলার আরজিতে উল্লেখ করেছেন, তার মেয়ে এখনও বয়সে শিশু। ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃক ইস্যু করা জন্ম সনদ অনুযায়ী তার মেয়ের বয়স মাত্র ১৪ বছর ১০ মাস। ইউনিয়ন পরিষদের জন্ম নিবন্ধন শাখার ইস্যুকৃত সনদ মতে, লাকিংমের জন্ম ২০০৫ সালের ২ মার্চ। তিনি বয়স প্রমাণের কাগজপত্র ও আদালতে জমা দেন। তার মেয়ে নাবালক এবং দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিয়ের বয়স হয়নি। সে স্বইচ্ছায় যায়নি, তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আতাউল্লাহরা জোরপূর্বক অপহরণ করে নিয়ে গেছে।
আদালতের আদেশে গত বছরের ৯ আগস্ট পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পরিদর্শক ক্যশেনু মারমা তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেন।
প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, ‘আমি এই মামলাটি তদন্ত করতে গিয়ে সরেজমিনে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি এবং স্বাক্ষীদের সঙ্গে কথা বলেছি। প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানবন্দীও নেওয়া হয়েছে। পাঁচ জন স্বাক্ষিই ভিকটিম লাকিংমের আত্মীয়। ওই পাঁচ জন ছাড়া অন্য কেউ লাকিংমেকে অপহরণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেনি। তাই লাকিংমে স্বইচ্ছায় চলে গেছে মর্মে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।’
এদিকে মামলার বাদী লালা অং তদন্ত কর্মকর্তার প্রতিবেদনের ওপর নারাজি দিয়েছেন। এ বিষয়ে আদালত পরবর্তী শুনানীর তারিখ আগামী ২৮ জানুয়ারি নির্ধারণ করেছেন বলে জানিয়েছেন বাদীর আইনজীবী মোহাম্মদ মহি উদ্দীন খান।
তিনি জানান, লাকিংমের মৃত্যুর মাত্র ১৩ দিন আগে একটি সন্তান জন্ম দিয়েছে। নবজাতক বর্তমানে আতাউল্লাহর মায়ের কাছে রয়েছে।
গত ২৮ ডিসেম্বর লাকিংমে চাকমার গ্রাম পরিদর্শনে যাওয়া মানবাধিকার কর্মী দলের অন্যতম সদস্য কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ফারাহ তানজিম টিটিল বলেন, ‘ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা, আতাউল্লাহর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এবং লাকিংমের বয়স সংক্রান্ত বিভিন্ন কাগজপত্র স্বচক্ষে যাছাই-বাছাই করে দুটি বিষয় পুরোপুরি স্পষ্ট হয়েছে। তা হলো লাকিংমে স্বইচ্ছায় কারও সঙ্গে যায়নি। সে পরিকল্পিত অপহরণের শিকার। দ্বিতীয়ত, দেশের প্রচলিত আইন মতে সে নাবালিকা এবং তার বিয়ের বয়স হয়নি।’
লাকিংমের মৃত্যুর কয়েকদিন পর আতাউল্লাহ দাবি করেন, ‘লাকিংমে আমার স্ত্রী। বিয়ের পর আমরা কুমিল্লায় ছিলাম। লক ডাউনের সময় টেকনাফে ফিরি। আমাদের একটি সন্তান আছে। সন্তান জন্মের কিছুদিন পর এক অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য সে পার্লারে গিয়ে সাজগোজ করবে বলে জানায়। এ নিয়ে অভিমান করে বিষ পান করে। সামান্য বিষয় নিয়ে সে এমনটা করবে ভাবতেও পারিনি। আমরা খুব সুখে ও শান্তিতে ছিলাম।’
এদিকে আজ সোমবার (৪ জানুয়ারি) বেলা ১১টায় কক্সবাজার জেলা শহরের পৌরসভা কার্যালয়ের সামনের সড়কে লাকিংমে চাকমার অপহরণ, বেআইনি বাল্য বিয়ে, ধর্ষণ ও ধর্মান্তরিত করার প্রতিবাদে এবং তার হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক, হিউম্যান রাইটস্ ডিফেন্ডারস ফোরাম, নারী প্রগতি সংঘ, রাখাইন ওমেন ফোরাম, আদিবাসী ছাত্র পরিষদ, তঞগ্যা স্টুডেন্ট কাউন্সিল এই কর্মসূচির আয়োজন করে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।