জুমবাংলা ডেস্ক : গৃহবধূ সগিরা মোর্শেদ (৩৪)। ১৯৮৯ সালের ২৫ আগস্ট বিকেল ৫টায় মেয়েকে (ভিকারুননেসা স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী) স্কুল থেকে আনতে যান। স্কুলের সামনে পৌঁছানো মাত্রই অজ্ঞাতনামা দুইজন তার হাতের ব্যাগ এবং বালা ধরে টান দেয়। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে অজ্ঞাতনামা সেই ব্যক্তি তাকে গুলি করে পালিয়ে যান। পরে হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক সগিরা মোর্শেদকে মৃত ঘোষণা করেন।
এ ঘটনার পরে নিহতের স্বামী আব্দুস ছালাম চৌধুরী একটি মামলা দায়ের করেছিলেন সেসময়। সেই মামলায় একজনের নামে চার্জশিটও জমা দিয়েছিল পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। কিন্তু দীর্ঘ ৩০ বছর পেরিয়ে গেলেও শেষ হয়নি সেই মামলা।
ঘটনার ৩০ বছর পরে পুনরায় ওই মামলার তদন্ত শুরু করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।পিবিআইয়ের সেই তদন্তে বেরিয়ে আসে এই হত্যাকাণ্ডের আসল রহস্য।
তদন্ত শেষে পিবিআই জানায়, নিহত সগিরা মোর্শেদকে হত্যায় তার আপন ভাসুর চিকিৎসক ডা. হাসান আলী চৌধুরী এবং তার স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা শাহীন ছিলেন হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী। আর এই হত্যাকাণ্ডে সহায়তা করেছেন ডা. হাসান আলী চৌধুরীর শ্যালক আনাস মাহমুদ ওরফে রেজওয়ান। হত্যাকাণ্ডের জন্য সে সময়ের দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী মো. মারুফ রেজাকে ভাড়া করেছিলেন তারা।
পিবিআই জানায়, সগিরা মোর্শেদকে হত্যার পর তার লাশ দেখতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়েছিলেন হত্যাকাণ্ডে জড়িতরা। জানাজা নামাজেও অংশ নেয় অভিযুক্ত ওই তিন ব্যক্তি। এমনকি একই পরিবারের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও গত ৩০ বছর ধরে কেউই বুঝতে পারেনি যে তারাই এই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে ধানমন্ডিতে পিবিআই কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান সংস্থাটির প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার। তিনি জানান, এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত চার আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতরা হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছেন।
যে কারণে মামলাটি ঝুলে আছে ৩০ বছর
পিবিআই সূত্রে জানা যায়, এই মামলাটি প্রথম তদন্ত করেছিলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের ডিবির তৎকালীন পুলিশ পরিদর্শক এবিএম সুলতান আহম্মেদ। পরবর্তীতে ডিবির অপর এক পুলিশ পরিদর্শক মো. জলিল ১৯৯০ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সাক্ষ্য প্রমাণাদি এবং পারিপাশ্বিক তদন্তে ছিনতাইকারী হিসেবে মিন্টু ওরফে মন্টু নামের এক জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
এরপর অভিযুক্তের বিরুদ্ধে চার্জগঠন করে বিচারকাজ শুরু হয়। বিচারকাজ চলাকালে ছয়জন সাক্ষীর জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়েছিল সে সময়। তবে সাক্ষীদের জবানবন্দিতে আসামি মারুফ রেজার নাম আসায় এই মামলাটি আরও অধিকতর তদন্তের জন্য আদালতে আবেদন করা হয়। তখন আদালত অধিকতর তদন্তের জন্য আবেদন মঞ্জুর করেন।
আদালতের এই আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে তখন মারুফ রেজা হাইকোর্ট বিভাগে ক্রিমিনাল রিভিশনে একটি মামলা দায়ের করেছিলেন। এরপরেই দীর্ঘ সময়ের জন্য ঝুলে যায় মামলাটি।
৩০ বছরে ২৬ তদন্তকারী কর্মকর্তা
চাঞ্চ্যল্যকর এই মামলাটিতে গত ৩০ বছরে অনেক বার তদন্তকারী কর্মকর্তার পরিবর্তন হয়েছে। মামলার নথি এবং পিবিআই সূত্রে জানা যায়, ১৯৯০ সাল থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত মোট ২৬ জন তদন্তকারী কর্মকর্তা এই মামলাটি তদন্ত করেছেন। মামলাটির সর্বশেষ তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে রয়েছেন পিবিআই’র পুলিশ পরিদর্শক রফিকুল ইসলাম।
যেভাবে গ্রেপ্তার হয় চার আসামি
ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ‘গত ১১ আগস্ট উচ্চ আদালত থেকে মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য পিবিআই নির্দেশ প্রদান করা হয়। পিবিআইয়ের তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক রফিকুল ইসলাম এই মামলার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীর সঙ্গে কথা বলে তার জবানবন্দি আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় লিপিবদ্ধ করেন। এরপর গত ১০ নভেম্বর মামলার সন্দেহজনক আসামি আনাছ মাহমুদ ওরফে রেজওয়ানকে (৫৯) রামপুরা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তার স্বীকারোক্তি মোতাবেক গত ১২ নভেম্বর আসামি ডা. হাসান আলী চৌধুরী (৭০) ও তার স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা ওরফে শাহিনকে (৬৪) ধানমন্ডি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। সর্বশেষ গত ১৩ নভেম্বর মো. মারুফ রেজাকে (৫৯) বেইলি রোডের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পিবিআই প্রধান বলেন, ‘নিহত সগিরা মোর্সেদ হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ডা. হাসান আলী চৌধুরী (৭০) ও তার স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা ওরফে শাহিন (৬৪)।আর আনাছ মাহমুদ ওরফে রেজওয়ান (৫৯) এবং মো. মারুফ রেজা পরিকল্পনা মোতাবেক হত্যায় অংশগ্রহণ করেছিল।’
যে কারণে খুন হন সগিরা মোর্শেদ
পিবিআই প্রধান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘নিহত সগিরা মোর্শেদ তার স্বামীর সঙ্গে থাকতেন। সেই বাড়িতেই বসবাস করত হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ডা. হাসান আলী চৌধুরী ও তার স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা ওরফে শাহিন।এক বাসায় থাকার কারণে ডা. হাসান আলী চৌধুরীর স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা ওরফে শাহিনের সঙ্গে সগিরা মোর্শেদের গৃহস্থালীর বিষয়ে দ্বন্দ্বের শুরু হয়। ময়লা ফেলা ও বিভিন্ন কারণে ডা. হাসান আলী চৌধুরীর স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা ওরফে শাহিনের সঙ্গে সগিরা মোর্শেদের অনেকবার দ্বন্দ্ব হয় সেসময়।’
পিবিআই প্রধান বলেন, ‘১৯৮৯ সালের প্রথম দিকে সান আলী চৌধুরীর স্ত্রী সায়েদাতুল শাহিন বলেন যে, “সগিরা মোর্শেদকে একটু শায়েস্তা করতে হবে।’ স্ত্রীর কথায় ডা. হাসান আলী চৌধুরী রাজি হয়। এরপর তারা রাজধানী সিদ্ধেশ্বরী এলাকার দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী এবং তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসানের ভাগ্নে মারুফ রেজার সঙ্গে সলাপরামর্শ করেন। রেজা ডা. হাসান আলী চৌধুরীর পেশেন্ট ছিলেন সেমসয়।’
সগিরা মোর্শেদকে শায়েস্তা করার জন্য ডা. হাসান আলী চৌধুরী আসামি মারুফ রেজার সঙ্গে কথা বলেন। আর এই কাজের জন্য ডা. হাসান আলী চৌধুরী আসামি মারুফ রেজাকে তৎকালীন ২৫ হাজার টাকা দিতে চেয়েছিলেন। হাসান আলী চৌধুরীর শ্যালক আনাস মাহমুদকে মারুফ রেজার সহযোগী হিসেবে নিয়োগ করেন।তারা যাতে সে সগিরা মোর্শেদকে দেখিয়ে দিতে পারে।
যেভাবে খুন হন সগিরা
মামলার বর্ণনা এবং তদন্ত সুত্রে পিবিআই জানায়, ঘটনার দিনে ডা. হাসান আলী চৌধুরী তার শ্যালক আনাস মাহমুদকে বেলা ২টার দিকে ফোন করে মৌচাক মার্কেটের সামনে আসতে বলে। অপর আসামি মারুফ রেজা মোটর সাইকেলযোগে মৌচাক মার্কেটের সামনে আসবে বলে জানায়। ডা. হাসান আলী চৌধুরী তার শ্যালককে মারুফ রেজার সঙ্গে গিয়ে সগিরা মোর্শেদকে দেখিয়ে দিতে বলে। বিকেল ৪টা ৪০ মিনিটে ডা. হাসান আলী চৌধুরীর শ্যালক আনাস মাহমুদ মারুফ রেজার মোটর সাইকেলের পিছনে উঠে মৌচাক মার্কেটের সিদ্ধেশ্বরী কালি মন্দিরের গলি দিয়ে সিদ্ধেশ্বরী রোডে ঢোকেন। তারা সগিরা মোর্শেদকে রিক্সা যোগে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের দিকে যেতে দেখে তাদের অনুসরণ করেন। মারুফ রেজা ভিকারুননিসা নূন স্কুলের একটু আগে মোটর সাইকেল দিয়ে সগিরা মোর্শেদের রিক্সা ব্যারিকেড দেয়।
এরপর সগিরা মোর্শেদের হাত ব্যাগ নিয়ে নেয় মারুফ রেজা এবং তার হাতের চুড়ি ধরে টানা হেঁচড়া করে। তখন সগিরা মোর্শেদ আসামি আনাস মাহমুদকে চিনে ফেলে এবং বলে ‘এই আমি তো তোমাকে চিনি, তুমি এখানে কেন?’। এই কথা বলার পরপরই মারুফ রেজা ব্যাগ ছেড়ে দিয়ে সগিরা মোর্শেদকে কোমর থেকে পিস্তল বের করে একটি গুলি করে যা সগিরা মোর্শেদের হাতে লাগে। এরপর সে সগিরা মোর্শেদকে আরও একটি গুলি করে যা সগিরা মোর্শেদের বাম বুকে লাগে। এ সময় সগিরা মোর্শেদ রিক্সা হতে পড়ে যায়। তখন মারুফ রেজা আরও দুটি ফাঁকা গুলি করে মোটর সাইকেল যোগে আসামি আনাস মাহমুদসহ পালিয়ে যায়।
মামলা তুলে নিতে চিরকুট, বেনামি টেলিফোনে হুমকি
হত্যার পরবর্তীতে আসামি ডা. হাসান আলী চৌধুরীর মামলার বাদী আব্দুস সালাম চৌধুরীকে মামলাটি উঠিয়ে নেওয়ার জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হুমকিসহ নানা চাপ দিয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলন শেষে নিহত সগিরা মোর্শেদের স্বামী মামলার বাদী আব্দুস ছালাম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার স্ত্রী ছিলেন একজন আদর্শ নারী। তিনি তৎকালীন সময়ের একজন মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। তাকে হারানোর ব্যথায় আমি আর দ্বিতীয় বিয়ে পর্যন্ত করি নাই। আমার তিন মেয়েকে কোনো মতে আগলে রেখে মানুষ করার চেষ্টা করেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার স্ত্রী মারা যাবার পরে খুনিরা বাসার দরজার নিচ দিয়ে চিরকুট লিখে হুমকি দেওয়া হতো। সেখানে লেখা থাকতো, “তোমার তিন মেয়েকে নিয়ে ভালো থাকো, মামলা নিয়ে বাড়াবাড়ি করবে না।” এছাড়া মামলা উঠিয়ে নেওয়ার জন্য আমাকে অনেক বার হুমকিও দেওয়া হয়েছে।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।