অনিল চন্দ্র রায়, কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি: আগামীকাল ৩১ জুলাই ছিটমহল বিনিময়ের ৪ বছর পূর্তি উদযাপন করা হবে। ছিটমহল বিনিময়ের মাত্র ৪ বছর হলো। খুব বেশি সময় নয়। এরই মধ্যে ছিটমহলবাসীর যেন ঘুচে গেছে র্দীঘ ৬৮ বছরের বঞ্চনা। ছিটমহলবাসীর ৬৮ বছরের ঘোর অন্ধকারের বুকে জেগেছে আলোর বন্যা।
ছিটমহল বিনিময়ের ৪ বছরের মাথায় ঘরে ঘরে বিদ্যুতের আলো, প্রশস্ত পাকা রাস্তা, ফায়ার সার্ভিস স্টেশন, সরকারি উদ্যোগে নির্মিত সৃদৃশ্য মসজিদ ও মন্দির, বিটিসিএল অপটিক্যাল ফাইবারের মাধ্যমে টেলিফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ, ডিজিটাল সেন্টার, স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসা এ যেন আলাদিনের চেরাগের ষ্পর্শে বদলে গেছে এক নতুন জনপদ দাসিয়ারছড়া।
আগামীকাল ৩১ জুলাই ছিটমহল বিনিময়ের ৪ বছর পূর্তিতে বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছে বিলুপ্ত ছিটমহল দাসিয়ারছড়ার বাসিন্দারা। এর মধ্যে সন্ধা ৭টায় রয়েছে আলোচনা সভা, ৯টায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও রাত ১২টা ১ মিনিটে ৬৮টি মোমবাতি প্রজ্জলন ও বঙ্গবুন্ধর প্রতিকৃতিতে পুস্পমাল্য অর্পন, প্রতিটি বাড়িতে আলোক সজ্জাসহ, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ১৮টি মসজিদে মিলাদ মাহফিল ও ৩টি মন্দিরে বিশেষ প্রার্থনা হবে।
১ আগস্ট ছিটমহল বিনিময়ের ৪ বছর পূর্তিতে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি প্রাপ্তি থাকায় খুশি বিলুপ্ত ছিটমহলের বাসিন্দারা।
কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার বিলুপ্ত দাসিয়ারছড়া ছিটমহলের অধিবাসীরা ২০১৫ সালের ১ আগস্ট থেকে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে মিশে গিয়ে তাদের ৬৮ বছরের অবরুদ্ধ জীবনের অবসান ঘটে। মূল ভূখণ্ডে যুক্ত হওয়ার তিন বছরের মধ্যে বর্তমান সরকারের ব্যাপক উন্নয়ন ছিটবাসীদের কল্পনাকেও হার মানিয়েছে। এখন আর কোন অবরুদ্ধ জীবন নয়, স্বাধীনভাবে বাংলাদেশি নাগরিক হয়ে জীবন-যাপন করছে পুরো ছিটমহলবাসী। প্রতিটি পরিবারের ছেলেমেয়ে স্থানীয় স্কুল-কলেজে পড়ার সুযোগ ছাড়াও দেশের বড় বড় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ছে। অনেকেই বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করে পরিবারের স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনছে। এখন বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে যেসব সুযোগ সুবিধা পাওয়ার কথা, তার সবই পাচ্ছে সাবেক ছিটমহলের অধিবাসীরা।
এলজিইডি সূত্রে জানা গেছে, গত চার বছরে বিশেষ বরাদ্দ প্রায় ২২ কোটি টাকার বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ হয়েছে দাসিয়ারছড়ায়। এর মধ্যে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে ৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন, ১৮ কোটি টাকা ব্যয়ে এলজিইডির মাধ্যমে ২৪ কিলোমিটার পাকা রাস্তা তৈরী হয়েছে দাসিয়ারছড়ায়। ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে কালিররহাটে কমিউনিটি রির্সোস সেন্টার, ৯০ লাখ টাকা ব্যয়ে ৫টি মসজিদ, ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি মন্দির, ২ কোটি ১৯ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি ব্রিজ, ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে ১০টি হত দরিদ্র পরিবারের বসতবাড়ি নির্মাণ উল্লেখযোগ্য।
অন্যদিকে ভূমি জটিলতার বিষয়টি সম্পুর্ণভাবে নিরসন হয়ে গেছে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন ১ হাজার ৬৪৩ দশমিক ৪৪ একর ও সরকারি খাস খতিয়ানভুক্ত ৯ একর জমির প্রাক জরিপ শেষ করে খতিয়ান হস্তান্তর করা হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত কল্পে স্বাস্থ্য বিভাগ কর্তৃক ৩টি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ করা হয়েছে। দাসিয়ারছড়াসহ বিলুপ্ত ছিটমহলে বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তির ৭৫ দিনের মধ্যে প্রায় ২ হাজার ৫৬২ পরিবারে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়েছে। এখন আর কোন বাড়িই নেই বিদ্যুৎবিহীন জীবন। দেয়া হয়েছে দ্রুত গতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সরকারের সর্বোচ্চ মহল এখানকার সুবিধা অসুবিধার খোঁজ নিচ্ছেন। ডিজিটাল সাব সেন্টার থেকে স্বল্পমূল্যে দেয়া হচ্ছে তথ্য প্রযুক্তির সেবা।
ইউনিসেফের অর্থায়নে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি স্থাপন করেছে ১৫টি প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা কেন্দ্র। এছাড়া ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছে ১৪টি মসজিদ ভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কেন্দ্র। উপজেলা কৃষি অফিসার অর্থায়নে কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও কৃষি যন্ত্রপাতি দেয়া হয়েছে। দাসিয়ারছড়ায় ঘরে ঘরে সুপেয় পানি আর স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত হয়েছে। আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বেকার যুব ও যুব মহিলাদের দেয়া হয়েছে নানা ট্রেডে প্রশিক্ষণ।
দাসিয়ারছড়া বেসরকারি নিন্মমাধ্যমিক বিদ্যালয় ও স্কুল এন্ড কলেজসহ মোট ৬টি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এগুলো হলো দাসিয়ারছড়া বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়, দাসিয়ার ছড়া নিন্মমাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, দাসিয়ারছড়া সমন্বয়পাড়া নিন্মমাধ্যমিক বিদ্যালয়, মইনুল হক নিন্ম মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মিশকাত আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজ ও ফজিলাতুন্নেছা দাখিল মাদ্রাসা। এই ৬ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দাসিয়ারছড়ার প্রায় ৭০০ জন ছাত্রছাত্রী পাঠদান করছে। তবে এসব প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত না হওয়ায় কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে কিছুটা হতাশা বিরাজ করছে।
৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থী আশামনি, জেসমিন আক্তার ও ৩য় শ্রেণীর শিক্ষার্থী সাথী আক্তার, মেঘলা রোজিনা আক্তার জানান, নিজ জন্মভুমিতে পড়ালেখা করছি। আমরা এখন বাংলাদেশি নাগরিক হয়ে পড়ালেখা করছি। সরকার বই ও উপবৃত্তি দিয়েছে। আমরা হাসিমুখে পড়ালেখা চালিয়ে যাবো।
দাসিয়ারছড়া সমন্বয়পাড়া নিন্ম মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক নুর ইসলাম ও কামালপুর মইনুল হক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জানান, এতদিন মিথ্যা ঠিকানা দিয়ে পড়ালেখা করে ‘নিজের টাকায় স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছি। নিয়মিত ক্লাস নিচ্ছি। কিন্তু বেতন-ভাতার খবর নেই।
একই কথা বলেন দাসিয়ারছড়া বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় শিক্ষক জাকিরসহ কয়েকজন শিক্ষক। তারা তাদের প্রতিষ্ঠানের দ্রুত বেতন ভাতার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানিয়েছেন।
দাসিয়ারছড়া কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বাস্থ্যকর্মী মোহেছেনা আক্তর মিনা জানান গত চার বছর ধরে বিলুপ্ত ছিটমহলে গড়ে প্রতিদিন গর্ভবতী মাসহ ৩৫ থেকে ৪০ জন রোগী স্বাস্থ্যসেবা নিচ্ছেন। চিকিৎসাসেবা পাওয়ায় দাসিয়ারছড়াবাসী খুবই খুশি ।
দাসিয়ারছড়ার সাবেক পঞ্চায়েত প্রধান নজরুল ইসলাম, মোজাফর আলী ও বেলাল মিয়াসহ অনেকেই জানান, এখন তারা বাংলাদেশের নাগরিক পরিচয় দিতে পেরে আনন্দিত ও গর্বিত। একজন বাংলাদেশি নাগরিক হয়ে গত চার বছর ধরে আমাদের ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি স্কুল-কলেজে পড়ালেখা করছে। কেউ কেউ চাকুরিও করছে। কৃষি অফিসার আসছে। প্রশিক্ষণ দিয়ে বিভিন্ন জাতের ধান ও সবজি চাষ করে আমাদের দাসিয়ারছাড়ায় অনেকেই এখন সফল কৃষক। সরকার আমাদের বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা দিচ্ছে।
সাবেক ছিটমহল আন্দোলনের নেতা গোলাম মোস্তফা ওই মইনুল হক বলেন, আমাদের প্রাণের দাবি দাসিয়ারছড়া ইউনিয়ন ঘোষণা না হলেও গত চার বছরে সরকার ব্যাপক হারে যেভাবে উন্নয়ন করেছে তাতেই আমরা সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ।
এ প্রসঙ্গে ফুলবাড়ী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোছা. মাছুমা অরেফিন বলেন, বিলুপ্ত ছিটমহলের অবরুদ্ধ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকার বদ্ধপরিকর। এছাড়াও গত চার বছরে বিলুপ্ত ছিটমহলে সরকারি ও বেসরকারিভাবে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে।
তিনি জানান, ২২ কিলোমিটার পাকা সড়কের নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে, ৩০টি দুস্থ পরিবারে স্যানিটারি ল্যাট্রিন স্থাপন, ৮০টি দুস্থ পরিবারে নলকুপ স্থাপন, ৫টি মডেল মজজিদ, ১টি মডেল মন্দির, ১টি শ্মশান ঘাট, ১টি শহীদ মিনার, নীনকোমর নদীর উপর ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে সেতু নির্মাণ, ১৫ মিটার দৈর্ঘের ৪টি ব্রিজ নির্মাণ, ৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ, ৬৩০ জনকে বয়স্ক ভাতা, ২৮২ জনকে বিধবা ভাতা, ৬৪ জন প্রতিবন্ধী ভাতা, বিশুদ্ধ পানীয় সরবরাহের জন্য ৪৫টি নলকুপ স্থাপন, ৪৭টি ল্যাট্রিন, ভিজিডি কার্ড ১৮৫৯ জন, মাতৃতকালীন ভাতা ২০০ জন, সেলাই মেশিন ৫৫ জন, একটি বাড়ি একটি খামার সমিতিতে ৩৬০ জনকে মোট ২৪ লাখ ২৩ হাজার টাকার ঋন প্রদান, ৫০০ হতদরিদ্র পরিবারকে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় অন্তভুক্ত করা হয়েছে, ১টি নিন্মমাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, ২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় একাডেমিক স্বীকৃতি পেয়েছে, এছাড়াও ১টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ১টি দাখিল মাদ্রাসা স্থাপন করা হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোছা. মাছুমা অরেফিন জানান, ২ হাজার ১৬০ জন নারী-পুরুষকে স্বাক্ষরতার আওতায় আনা হয়েছে। এই এলাকায় উন্নয়নের কাজ অব্যাহত থাকবে।
২০১৫ সালের ১ আগস্ট থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ১১১টি এবং ভারতের অভ্যন্তরে ৫১ বাংলাদেশি ছিটমহল বাংলাদেশ ও ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে মিশে গিয়ে তাদের ৬৮ বছরের অবরুদ্ধ জীবনের অবসান ঘটে। এখন ছিটমহল শুধু ইতিহাস ও স্মৃতি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।