আন্তর্জাতিক ডেস্ক : একদিকে মহামারির ছোবল অন্যদিকে অর্থনৈতিক সঙ্কটের পাশাপাশি প্রতিনিয়ত নিরাপত্তা হুমকিতে বিশ্বের অধিক জনবহুল দেশ ভারত। জাতীয় পর্যায়ে নানা সমস্যা যখন জর্জরিত তখনই সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ছয়মাস বিরতি দিয়ে শুরু হয়েছে অধিবেশন। আর এই অধিবেশনে চলমান সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে সংসদের। যদিও এতো দিন বিরতি দিয়ে অধিবেশন শুরুর নিয়ম ভারতের সংবিধানে নেই। মহামারি করোনার কারণে গত মার্চের পর সবগুলো অধিবেশনই বাতিল হয়।
ভারতে ৪৫ লাখের বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত,যা বিপর্যয়ের তালিকায় বিশ্বের দ্বিতীয় অবস্থানে। এরপরই রয়েছে ব্রাজিল, রাশিয়া। তালিকার প্রথমে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। করোনায় প্রতিনিয়তই খারাপ পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে ভারত। বিশেষ করে প্রান্তিক পর্যায়ে করোনায় আক্রান্ত এবং মৃত্যুর তালিকার হিসেব সরকারের কাছে নেই বললেই চলে।
ভাগ্যক্রমে কোভিড ঊনিশে মৃত্যুর হার তুলনামূলক কম। ৫৫ লাখ মানুষের বিপরীতে ১ শতাংশ মানুষ করোনায় মারা গেছেন। তবে করোনায় যতটানা ক্ষতি হয়েছে তার থেকে গত মার্চ থেকে দেশজুড়ে অকর্যকর লকডাউনের কারণেই সঙ্কট তীব্রতর হয়েছে।
গত বছরের এপ্রিল-জুন প্রান্তি তুলনায় এ বছরের একই সময়ে জিডিপি ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ কমেছে। এই সময়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় সবচেয়ে খারাপ অর্থনীতির অভিজ্ঞতা ভারতের। করোনাকালীন বেকারত্বের হারের চিত্রটাও ঊর্ধ্বগতির দিকে। দুই কোটির বেশি বেতনভুক্ত মানুষ স্থায়ী চাকরি হারিয়েছেন। জীবিকা হারিয়েছেন লাখ লাখ দিন মজুর।
লকডাউনের কারণে আর্থিক সঙ্কটে পড়ে ভারতের বহু ক্ষুদ্র এবং মাঝারি ব্যবসায়ী তাদের প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন। আপনি যদি একটু গ্রামীণ জনপদের দিকে তাকান তাহলে দেখবেন, দেশজুড়ে ব্যর্থ লকডাউনে চলাকালীন লাখ লাখ অভিবাসী শ্রমিক হতাশায় বাড়ি ফিরে গেছেন। হয়তো সেখানে নতুন করে কিছু করার স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু সেখানে কি হয়েছে? তার খোঁজ কি কেউ রেখেছেন?
অভিবাসী শ্রমিকদের গ্রামঞ্চলের অচল অর্থনীতি তাদের জীবনমানকে উন্নতি তো করতে পারেনি বরং আরো পেছনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার অর্থনৈতিক মন্দাকে থামাতে একেবারেই অসহায় বলে মনে হয়েছে। দেশব্যাপী এই সঙ্কট দূর করতে মোদি যে পরিকল্পনায় নিয়ে হাটছিলেন তা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।
এই সঙ্কট এতটা খারাপ না হলেও, চীনের সাথে বিতর্কিত সীমান্তে একটি বড় সংকট মোড় নিয়েছে। সীমান্তে সংঘাতে জড়িয়ে লাদাখের হিমালয়ে গেল জুনে ২০ ভারতীয় সেনাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সঙ্কট এড়াতে আলোচনার মাধ্যমে লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল হতে চীনা সেনা সরাতে ব্যর্থ হয় নয়াদিল্লি। তবে প্রাণহানি আর উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যে সম্প্রতি দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠকে সীমান্ত নিয়ে একটি চুক্তিতে পৌঁছেছে।
পূর্ব লাদাখ সীমান্তে উত্তেজনা নিরসনে পাঁচ দফা পরিকল্পনার বিষয়ে একমত হয় ভারত ও চীন। নতুন এ পরিকল্পনায় সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় দুই দেশের মধ্যে বলবৎ ১৯৯৩ এবং ১৯৯৬ সালের সীমান্ত চুক্তিগুলো মেনে চলা এবং যে কোনো ধরনের উত্তেজনা নিরসনে সীমান্তে শান্তি ও শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।
কিন্তু এই চুক্তি আসলে কতটা বাস্তবায়ন হবে তা নিয়ে শঙ্কার কালো মেঘ রয়ে গেছে।
এর মধ্যে, কাশ্মীরে পাকিস্তান তার আন্তঃসীমান্ত জঙ্গিবাদকে আরও বাড়িয়েছে। গত বছরে কাশ্মীরে বিশেষ মর্যাদা ৩৭০ ধারা রদ থেকে শুরু করে জঙ্গি দমন কার্যক্রমের পর দু’দেশের সীমান্তে অস্থিরতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা নিয়ে অনেকে আশঙ্কা করে বলছেন, চলতি বছরের শেষের দিকে ভারত একটি দ্বি-মুখী যুদ্ধের মুখোমুখি হতে পারে। আর এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে চলতি অধিবেশনে শক্তভাবে তুলে ধরা উচিত।
কিন্তু অধিবেশন শুরুর আগেই ভারতের আইনসভায় অস্বাভাবিক ও সংকীর্ণ পরিস্থিতি দেখা গেছে। কারণ, করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট না নিয়ে কোন এমপি লোকসভার অধিবেশনে যোগ দিতে পারবে না, সরকারের পক্ষ থেকে সাফ জানিয়ে দেয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে কমিয়ে আনা হয়েছে অধিবেশনের সময়। সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি হলো, সরকার এবং প্রিজাইডিং অফিসাররা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সংক্ষিপ্ত অধিবেশনগুলি পরে তারা প্রশ্নোত্তর দিয়ে দেবে। এমপিদের জন্য একমাত্র সুযোগ ছিল, বিভিন্ন বিষয়ে মন্ত্রীর কাছ থেকে লিখিত উত্তরের। কিন্তু তা না করায় সরকারকে অনেক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। নরেন্দ্র মোদি দায়িত্ব নেয়ার ৬ বছরের মধ্যে তার কার্যালয়ে একক সাংবাদিক সম্মেলন করতে সক্ষম হননি। এতে মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলি সরকারের সফলতা বা অন্য কোন বিষয়াদি কোন ধরনের প্রশ্নের সুযোগ তো পাচ্ছেই না বরং সম্প্রতি একজন বলিউড অভিনেতার আত্মহত্যা সরকারের ভাবমূর্তি হোঁচট খেয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে মোদি তার ব্যর্থতাকে ঢেকে সম্প্রতি নিজের বাগানে ময়ূরকে খাওয়ানোর এক উদ্ভট ফটো-শুটে ব্যস্ত সময় পার করতে দেখা গেছে। তাও আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছড়িয়ে পড়েছে। চীনের সঙ্গে সম্প্রতি সীমান্ত বিরোধী বিষয়ে যদি বলি, এ বিষয়ে সরকার চীনকে উপযুক্ত জবাব দিতে ব্যর্থ হয়েছে তা মানতে নারাজ হবে এটাই স্বাভাবিক। চীনের কাছে কোন কোন ভূখণ্ড হারায়নি নয়াদিল্লি এমন দাবি করেছে মোদি সরকার। যদিও কৃত্রিম উপগ্রহের তোলা ছবি ভিন্ন কথা বলছে।
ভারতের এক হাজার বর্গকিলোমিটার সীমান্ত এলাকা দখল হয়েছে বলে যে খবর বেরিয়েছে তা এক বিবৃতিতে প্রত্যাখান করেছে নয়াদিল্লি। এক হাজার বর্গকিলোমিটার (৩৮৬ বর্গমাইল) জমি দখলের বিষয়টি উড়িয়ে দেয়ায় বেশ আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করেছে শি জিনপিং সরকার।
সুতরাং সংসদের হাতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ রয়েছে, তবে অনেক সংসদ সদস্য আশঙ্কা করছেন এই গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলি করতে সক্ষম হবেন না।
কোভিড ঊনিশ এর কারণে সংক্ষিপ্ত হবে চলমান অধিবেশন। করোনায় আক্রান্ত হয়ে ইতিমধ্যে একজন সংসদ সদস্য মারাও গেছেন। প্রাণঘাতী করোনা সংক্রমণ থেকে সুরক্ষায় পার্লামেন্টে বেশ কিছু নিয়ম করা হয়েছে। এর মধ্যে মাস্ক পরা, সাংসদদের মধ্যে দুরত্ব এবং এক একজনের মাঝখানে প্লাস্টিকর পর্দা দিয়ে আরও দুরত্ব থাকায় এতো সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সংসদে আড়ালে চলে যাওয়ারই কথা।
ভারত সংসদীয় প্রক্রিয়ার বাহ্যিক বিষয়গুলিকে সম্মান জানালেও বিতর্ক, আলোচনা, মতবিরোধ এবং বিবেচনার যে মনোভাব তা সংসদে অনুপস্থিতই রয়ে যাবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত। ভাষান্তর: লুৎফর কবির স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
শশী থারুর: ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং বর্তমানে কংগ্রেস পার্টির নির্বাচিত এমপি
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।