জুমবাংলা ডেস্ক: বাংলাদেশে বিভিন্ন ঘটনায় গ্রেপ্তার করার পরে নারী ও পুরুষদের প্রায়শই গণমাধ্যমের সামনে হাজির করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো। খবর বিবিসি বাংলার।
সেখানে জব্দ করা জিনিসপত্র সাজিয়ে গণমাধ্যমের সামনে এমনভাবে তাদের উপস্থাপন করা হয় ও বর্ণনা তুলে ধরা হয়, যাতে বিচারের আগেই তারা জনমনে দোষী বলে চিহ্নিত হয়ে যান। অনেকের ক্ষেত্রে নানারকম আপত্তিকর বিশেষণও ব্যবহার হয়।
এরকম কর্মকাণ্ড বন্ধ করার বিষয়ে ২০১২ সালে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বাংলাদেশের হাইকোর্ট। তারপরেও সেটি বন্ধ হয়নি।
সর্বশেষ রবিবার মধ্যরাতে ঢাকায় তিনজন মডেল ও অভিনেত্রীকে আটক করার পর, মামলা হওয়ার আগেই মাদক দ্রব্যসহ তাদের গণমাধ্যমের সামনে উপস্থাপন করা হয়।
তাদের ক্ষেত্রে কিছু আপত্তিকর বিশেষণও ব্যবহার করা হয়।
গত দুইমাসে ঢাকাতেই এরকম অন্তত আটটি ঘটনা দেখা গেছে, যেখানে সন্দেহভাজনদের দোষী প্রমাণিত হওয়া বা মামলা দায়েরের আগেই গণমাধ্যমের সামনে হাজির করে অপরাধের বর্ণনা দেয়া হয়েছে।
কিন্তু সেখানে তাদের পক্ষে কোন বক্তব্য তুলে ধরার ছিল না।
যে ক্ষতি হয়, সেটা আর পূরণ হয় না
বাংলাদেশে আলোচিত সব ঘটনাতেই সন্দেহভাজনদের আটকের পর সরাসরি গণমাধ্যমের সামনে উপস্থাপন বা তাদের ছবি, পরিচয় প্রচার করা অনেকটা নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এখানে পুলিশের নিজস্ব বক্তব্য থাকলেও সেই আটককৃতদের কোন বক্তব্য দেয়ার সুযোগ দেয়া হয় না।
মানবাধিকার কর্মী নীনা গোস্বামী বলছেন, এসব ঘটনা ওই ব্যক্তিদের জন্য শুধুমাত্র মানহানিকর নয়, মানবাধিকারেরও লঙ্ঘন।
নীনা গোস্বামী বলছেন, যাকে এভাবে হাজির করা হয়, তিনি তো সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছেনই। বিশেষ করে নারীদের জন্য এক ধরনের অসম্মানজনক ভাষা ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ তাদের টার্গেট করে দোষী প্রমাণের আগেই দোষী বানিয়ে ফেলা হয়। মানবিকতা বা আমরা যে দৃষ্টিভঙ্গির কথাই বলি না কেন, কোনভাবেই এটা ঠিক নয়।
মানবাধিকার কর্মীদের অভিযোগ, এভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে অভিযোগের তদন্ত বা বিচারের আগেই তাদের অপরাধী হিসাবে ধারণা দেয়া হচ্ছে।
মানবাধিকার এই কর্মী প্রশ্ন তুলছেন, মিডিয়ার সামনে তাদের ছবি দিয়ে, পরিচয় তুলে ধরে এক ধরনের ট্রায়াল করে ফেলা হচ্ছে। পরবর্তীতে তিনি যদি দোষী প্রমাণিত না হন, তাহলে তার প্রতি বর্তমানে যে অন্যায়টা করে ফেলা হচ্ছে, সেটার বিচার কি হবে?
তিনি বলছেন, যাদের এরকম পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যেতে হয়, তাদের পারিবারিক, সামাজিক বা ব্যক্তিগত সম্মান হুমকির মুখে পড়ে।
ফলে পরবর্তীতে নির্দোষ প্রমাণিত হলেও ওই ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের সবাইকে নানারকম অসম্মান, অপমানের ভেতর দিয়ে যেতে হয়।
নারীদের জন্য সেই মাত্রা হয় আরও অনেক বেশি।
আইনের পরিষ্কার লঙ্ঘন
২০১২ সালে একজন বিচারক ফেনসিডিল সহ আটকের পর হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছিলো যে গ্রেফতার বা সন্দেহভাজন হিসেবে আটকের পর কোন ব্যক্তিকে যেন গণমাধ্যমের সামনে হাজির না করা হয়। কিন্তু এরপরেও সেই পরিস্থিতির তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি।
বরং সারা দেশেই গ্রেপ্তারের পর সন্দেহভাজনদের গণমাধ্যমের সামনে হাজির করা বা তাদের ছবি-পরিচয় সহ তথ্য সরবরাহ অব্যাহত রয়েছে।
এমনকি নারীদের ক্ষেত্রে অজ্ঞাত গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে নানারকম মানহানিকর বর্ণনাও প্রকাশ করা হয়ে থাকে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলছেন, এরকম উপস্থাপন আইনের পরিষ্কার লঙ্ঘন।
মি. বড়ুয়া বলছেন, মিডিয়াতে যাতে এভাবে তুলে ধরা না হয়, সেজন্যই কিন্তু হাইকোর্টের পরিষ্কার রায় রয়েছে। হাইকোর্ট ডিভিশন বা অ্যাপিলেট ডিভিশন যখন কোন অর্ডার দেন, সেটা আমাদের সংবিধান অনুযায়ী আইনে পরিণত হয়। সুতরাং এটা পরিষ্কারভাবেই আইনের লঙ্ঘন হচ্ছে।
তিনি বলছেন, আইন লঙ্ঘনের পাশাপাশি এটা গুরুতর অধিকার লঙ্ঘন।
কারণ যেকোনও ট্রায়ালে অভিযুক্তকেও বক্তব্য দেয়ার সুযোগ থাকতে হবে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যখন তাদের সম্পর্কে একতরফা বক্তব্য তুলে ধরে, তাদের সেখানে কোন বক্তব্য দেয়ার সুযোগ থাকে না।
আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলছেন, বিচার ব্যাপারটা তো হচ্ছে কোর্টের ব্যাপার। এখন যদি পুলিশ গ্রেপ্তারের পরে মিডিয়ায় ঘোষণা দিয়ে বলে যে, তিনি এই অপরাধ করেছেন, তাহলে তো আর বিচারের প্রয়োজন পড়ে না।
তিনি বলছেন, এসব ক্ষেত্রে পরবর্তীতে নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার পর সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মানহানির বা ক্ষতিপূরণের মামলা করতে পারেন।
যেহেতু রাষ্ট্রের একটি বাহিনীর দ্বারা তার সম্মানহানি হয়েছে, অতএব রাষ্ট্রকেই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
তবে বাংলাদেশে এভাবে কেউ আইনি প্রতিকার চেয়েছেন বলে জানা নেই মি. বড়ুয়ার, যদিও পরবর্তীতে আদালতে এদের অনেকেই নির্দোষ বলে প্রমাণিত হয়েছেন।
ফলে এভাবে সন্দেহভাজনদের তুলে ধরা নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন তুলছেন মানবাধিকার কর্মীরা।
কেন এ ধরণের প্রবণতা বন্ধ হচ্ছে না?
হাইকোর্টের আদেশ, মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবীদের প্রবল সমালোচনার পরেও আটককৃতদের এভাবে গণমাধ্যমের সামনে হাজির করা কখনোই বন্ধ হয়নি।
কেন বাহিনীগুলো এরকম কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছে?
এই বিষয়ে পুলিশের মুখপাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও, টেলিফোন বা ক্ষুদে বার্তা পাঠানোর পরেও তাদের কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মোখলেসুর রহমান বলছেন, অনেক সময় নিজেদের অর্জন তুলে ধরতে বাহিনীগুলো এসব কাজ করে থাকতে পারে। আমি যতদূর বুঝি, এটা বাহিনীগুলো করে থাকে তাদের অ্যাচিভমেন্ট দেখানোর জন্য যে, তারা একটি ভালো কাজ করেছে। দেশের মানুষের জন্য বা সমাজের জন্য সেটা ভালো হবে, আরও পাঁচজন অপরাধে জড়ানো থেকে শিক্ষা নেবে, এ ধরনের একটা চিন্তা থেকে তারা এই কাজ করে থাকতে পারে।
তবে পুরো বিষয়টি আইনের মধ্যে থেকেই করা উচিত বলে মনে করেন মি. রহমান।
তিনি বলছেন, যারা আইন প্রয়োগ করবেন, তাদেরকে সবসময় মনে রাখতে হবে যে, তাদের কর্মকাণ্ডগুলো আইনানুগভাবে হচ্ছে কিনা? সেটা না হলে এগুলো নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে এবং ফলাফলের ক্ষেত্রে আদালতে গিয়ে ভিন্ন রূপ ধারণ করলেও করতে পারে।
সতর্ক হতে হবে গণমাধ্যমকে
মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবীরা বলছেন, আদালতে দোষী প্রমাণিত হওয়ার আগেই গণমাধ্যমের সামনে দোষী সাজিয়ে উপস্থাপনের ফলে একজন ব্যক্তি সামাজিক ও ব্যক্তিগতভাবে যে ক্ষতির মুখোমুখি হন, পরবর্তীতে আদালতে নির্দোষ প্রমাণিত হলেও সেটা পূরণ করা সম্ভব হয় না।
গণমাধ্যমেও বাহিনীগুলোর বক্তব্য থাকলেও বেশিরভাগ সময় অভিযুক্তদের পক্ষের বক্তব্য থাকে না।
তাই তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আচরণে পরিবর্তন আনার পাশাপাশি গণমাধ্যমকে এসব সংবাদ প্রচারে সতর্ক ভূমিকা রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।