লিমন বাসার, বগুড়া : তিনি জলে ‘কুমির’, ডাঙায় হয়ে ওঠেন ‘হিংস্র বাঘ’। এমন উভয়চর অদ্ভুত মানুষটিকে কেউ চেনেন ‘লুত্ফর ডাকাত’ নামে, কেউ বা ডাকেন ‘যমুনার কুমির’। কখনো স্থলে, আবার কখনো জলে গুণ্ডামি শেষ করে তাঁর নিশ্চিন্ত তন্দ্রা আসে যমুনা নদীতেই কালো কাচে মোড়ানো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত (এসি) নৌকায়। কী নেই সেই রাজকীয় তরিতে। টিভিতে দেখেন নাটক-সিনেমা-গান, ঠাণ্ডা খেতে ইচ্ছা হলে তিনি ফ্রিজে হাত বাড়ান। চারপাশ পর্যবেক্ষণের জন্য রয়েছে সিসি ক্যামেরার কৃত্রিম চোখ। নৌকায় বসেই দেশ-বিদেশের খবর জানা হয়ে যায় ইন্টারনেট সংযোগের বদৌলতে। সব চলে সৌরবিদ্যুতে।
সেই নৌকায় বসে জুয়ার আসর, যাত্রাপালা আর গান-বাজনার নামে অনৈতিক সব কাজকারবার। তাঁর ওই প্রমোদতরি পাহারায় রয়েছে আরো চারটি বিলাসবহুল নৌকা। সেই নৌকাগুলোতে থাকে তাঁর গুণ্ডা বাহিনী। রূপকথা নয়, বাস্তবেই সিনেমাটিক গল্পটি বগুড়ার সারিয়াকান্দির। আর এই খলনায়কের পুরো নাম লুত্ফর রহমান (৪৫)। যিনি চরবাসীর কাছে এক মূর্তিমান আতঙ্ক।
যত ধরনের মাস্তানি আছে, সবটাই তাঁর জানা। একসময় নিজেই চুরি-ডাকাতি করতেন। এখন সর্দার বনে অপরাধ সমন্বয়ের জন্য গড়েছেন শতাধিক সদস্যের একটি বাহিনী। যমুনা নদীর ৫০০ কিলোমিটার জলপথেই লুত্ফর বাহিনীর বিচরণ। অনৈতিক কাজের তালিকাটাও ভ্রু কুঁচকে যাওয়ার মতোই। জল-স্থল সব জায়গায় বিস্তৃত তাঁর অপরাধের নেটওয়ার্ক। কৃষকের জমির ফসল লুট, পণ্যবাহী নৌকায় ডাকাতি, মাদক ও অস্ত্র কারবার, জুয়ার আসর, নারী নিয়ে যাত্রাপালা, গান-বাজনার নামে দেহব্যবসা, বিরোধপূর্ণ জমি নিজের নামে লিখে নেওয়া, ডাকাতিতে বাধা এলেই খুন, দুর্গম চরাঞ্চলে পলাতক আসামিদের আশ্রয় দেওয়া আর প্রহসনের সালিস—এ রকম সব অপরাধের গলিপথই তাঁর চেনা! লুত্ফর ছিলেন চালুয়াবাড়ী ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি। গত বছরের ১৮ অক্টোবর দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ এবং সংগঠনবিরোধী কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
সারিয়াকান্দির যমুনা নদীর চর চালুয়াবাড়ী ইউনিয়নের পূর্বপারের বহুলাডাঙ্গা গ্রামের মুছা শেখের ছেলে এই লুত্ফর। তাঁর পাশের ইউনিয়ন জামালপুরের মাদারগঞ্জ ও ইসলামপুর এবং আরেক পাশে গাইবান্ধার সাঘাটার জুমারবাড়ী এলাকা। তিন জেলার সীমান্ত এলাকার মধ্যে পড়েছে বহুলাডাঙ্গা গ্রাম। উত্তরের কুড়িগ্রাম থেকে পাবনার নগরবাড়ী ঘাট পর্যন্ত স্থল ও নৌপথে রাজত্ব করেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিভিন্ন চরাঞ্চলে তাঁর আছে বিশাল কয়েকটি খামার। সেখানে রয়েছে ৩০০ গরু ও ৪০০ মহিষ। চরের বিশাল এলাকায় পশুগুলোর বিচরণ। অভিযোগ আছে, তাঁর খামারের গরু-মহিষের বেশির ভাগই ডাকাতি করা। সোনাতলার তেকানী-চুকাইনগর এলাকার তালতলায় তিন বছর আগে তাঁর স্ত্রী বুলবুলি খাতুনের নামে জমি কিনে বাড়ি করেছেন লুত্ফর। সেটির দাম প্রায় কোটি টাকা। নীলফামারী সদরের রামগঞ্জ এলাকায় চার বছর আগে একটি বহুতল বাড়ি কিনেছেন তিনি। ওই বাড়ির দাম প্রায় দুই কোটি টাকা। এ ছাড়া শতাধিক বিঘা জমি ও পুকুরের মালিক তিনি। পরিবারের সদস্যদের নামেও বিভিন্ন ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা আমানত রাখা হয়েছে। নিজের নামে এলাকায় একটি হাটও করেছেন এই লুত্ফর।
ভয়ে স্থানীয় লোকজন তাঁর অপরাধ নিয়ে ‘টুঁ শব্দ’ করার সাহস পায় না। লুত্ফরের ছয়টি নৌকা ডাকাতি ও চাঁদাবাজির কাজে বেশি ব্যবহার হয়। এই নৌকাগুলোতে দুটি করে ইঞ্জিন লাগানো। এ কারণে নৌকাগুলোর গতি প্রায় স্পিডবোটের মতোই। কুড়িগ্রাম থেকে আসা কিংবা যাওয়া দূরপাল্লার নৌকা ও ট্রলারগুলো থেকে পাঁচ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করা হয়। রাতে আবার এসব নৌকাই ব্যবহার হয় ডাকাতির কাজে।
খুন, চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, মাদক, অস্ত্র, লুটপাটসহ তাঁর মাথার ওপর ঝুলছে ১৬টি মামলা। অভিযোগ রয়েছে সারিয়াকান্দি পুলিশের সঙ্গে ‘মধুর সম্পর্ক’ থাকায় গ্রেপ্তার এড়িয়ে তিনি নিরাপদেই আছেন। পুলিশ সূত্র জানায়, লুত্ফরের নামে সারিয়াকান্দি থানায় ছয়টি, সোনাতলায় তিনটি, জামালপুরের ইসলামপুরে তিনটি, গাইবান্ধার সাঘাটা থানায় দুটি এবং জয়পুরহাটের পাঁচবিবি থানায় দুটি করে মামলা রয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি মামলায় আদালত থেকে তাঁর নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি রয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, লুত্ফর আগে বিএনপি করতেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আট বছর আগে হঠাৎ যুবলীগ নেতা বনে যান। পাঁচ বছর আগে হয়ে যান ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি। গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে দল থেকে মনোনয়ন চেয়েও ব্যর্থ হন।
লুত্ফরের ভয়ে এলাকাছাড়া আবদুল হান্নান বলেন, ‘তাঁর অপকর্মের বিচার চেয়ে আমি তৎপর হয়েছিলাম। তখন পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার তো করেইনি, উল্টো লুত্ফরের হুমকিতে এখন আর নিজ এলাকায় যেতে পারছি না, পালিয়ে বেড়াচ্ছি।’
চালুয়াবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শওকত আলী বলেন, ‘লুত্ফরের অপরাধের কথা সবারই জানা, কিন্তু কেউ মুখ খোলে না। তার অত্যাচারে অনেকেই গ্রামছাড়া। প্রতিনিয়ত সে লুটপাট, ডাকাতি ও মাদক কারবার করে এলাকায় রামরাজত্ব কায়েম করেছে।’
এই পথে চলাচলকারী মাঝি আব্দুল হামিদ বলেন, ‘আমরা ভয়ে ওই এলাকায় ভাড়ায় যেতে চাই না। গেলে লুত্ফর ডাকাতকে চাঁদা না দিয়ে নদী পার হওয়া যায় না। অনেক লোককে সে আটকে মুক্তিপণ আদায় করেছে। তার ভয়ে এই পথে পণ্য পারাপারও অনেক কমে গেছে।’
বগুড়া জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম ডাবলু বলেন, যুবলীগ থেকে লুত্ফর রহমানকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তাঁকে দ্রুত আইনের আওতায় আনার ব্যাপারে পুলিশকে অনুরোধ করা হয়েছে।
যমুনা নদীর ‘রাজা’ লুত্ফর রহমান তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘রাজনীতি করলে গ্রামে পক্ষ-বিপক্ষ থাকে। প্রতিপক্ষরাই এসব অপবাদ ছড়াচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘এসি নৌকা শখ করে বানিয়েছি। যেহেতু রাজনীতি করি তাই কিছু ছেলে-পেলে সব সময় সঙ্গে থাকে।’
এ ব্যাপারে বগুড়ার পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভূঞা বলেন, ‘নদীতে ত্রাস তৈরি করেছে এই লুত্ফর ডাকাত। তবে গ্রেপ্তার এড়াতে সে এখন বাহিনীসহ গাঢাকা দিয়েছে। তার অপকর্ম বন্ধ করতে স্থানীয় ওসিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অচিরেই সে ধরা পড়বে।’ সূত্র: কালের কন্ঠ।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।