জুমবাংলা ডেস্ক : দেখতে বিচ্ছিন্ন এলাকা। গ্রামের তিনদিকে ফসলী ক্ষেত। পুরো এলাকায় যেতে একটি মাত্র কাঁচা রাস্তা। ঘিঞ্জি পরিবেশ। আশপাশে কোন লোকালয় নেই। এলাকায় ঢুকলে যে কারো গা ছমছম করবে। শরীরের লোম শিউরে উঠবে। কাঁচা রাস্তায় হাঁটাও দায়। কাঁচা রাস্তাও ডাকাতরা কোদাল দিয়ে কেটে রাখেন। নেই স্কুল, নেই মসজিদ। এলাকার ছেলে-মেয়েদের নিজের এলাকার ছেলে-মেয়েদের মধ্যেই বিয়ে দিতে হয়। নেই কবরস্থান। কবর দিতে হয় নিজ-নিজ বাড়িতে। ডাকাতদের সন্তানদের পাশের গ্রামের স্কুলেও ভর্তি করাতে পারে না। কারন ডাকাতের সন্তান বলে তাদের সবাই ঘৃণা করেন।
এটি নারায়নগঞ্জের রূপগঞ্জের আড়াইহাজারের মরদাসাদী গ্রাম। এ গ্রামের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষই পেশায় ডাকাত। লোকে এ গ্রামকে ‘ডাকাইত্তা গ্রাম’ বলেই চেনে। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, ডাকাইত্তা গ্রামের ডাকাতরা কেউ নিজ গ্রামে ডাকাতি করে না। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর গ্রামটির নাম শান্তিপুর রাখা হয়। সরজমিনে ঘুরে জানা যায়, আড়াইহাজারের মাহমুদপুর ইউনিয়নের একটি জনপদ মরদাসাদী। উপজেলা সদর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এ গ্রামটি । প্রায় ৪শ’ পরিবারের বসবাস এখানে। দুই হাজার লোকের মধ্যে ৯২৫ জন ভোটার। প্রায় ৩ যুগ ধরে এ এলাকার লোকজন বংশপসম্পরায় ডাকাতি করে আসছে। দাদার আমল পার হয়ে বাপের আমল। ছেলের আমল পারহয়ে নাতির আমল। নাতি পার হয়ে এখন পুতিরাও ডাকাতি পেশায় জড়িত।
এক কথায় এ এলাকার মানুষের রক্ত-মাংসের সঙ্গে মিশে গেছে ডাকাতি পেশা। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর স্থানীয় সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবু ও এলাকাবাসী মিলে গ্রামটির নাম শান্তিপুর রাখলেও সরকারী খাতাপত্রে এখনো সবাই মরদাসাদী গ্রাম হিসাবে চিনে। সবাই ডাকে ডাকাইত্তা গ্রাম বলে।
স্থানীয়রা জানান, স্বাধীনতার আগে থেকেই মরদাসাদী গ্রামের লোকজন ডাকাতির পেশার সঙ্গে জড়িত ছিল। এর আগে এলাকার মানুষ কৃষি পেশায় জড়িত ছিল। কৃষিকাজ ছেড়ে পরবর্তীতে তারা চরদখলের কাজে লাঠিয়াল হিসাবে কাজ করতেন। এরপর থেকেই তারা ডাকাতি পেশায় জড়িয়ে পড়ে। স্বাধীনতার পর এরা পুরোপুরি ডাকাতি পেশায় জড়িয়ে পড়ে।
১৯৭৫ সালের পর ডাকাতিই প্রধান পেশায় পরিণত হয় এ এলাকার মানুষের। এলাকাবাসী জানান, তৎকালীন এরশাদ সরকারের আমলে মরদাসাদী গ্রামটি পুড়িয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়। এ সময় গ্রামের ডাকাত দলের সব সদস্য প্রশাসনের কাছে ক্ষমা চাইলে গ্রামটি আর পোড়ানো হয়নি। বছর খানেক সময় ডাকাতি বন্ধ থাকলেও পরে ডাকাতরা আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এরপর থেকে বংশপরম্পরায় ডাকাতি পেশা চলছে। ডাকাতদের গ্রাম হওয়ায় এ এলাকার মেয়েদের কেউ বিয়ে করতে চায়না। তেমনিভাবে ছেলেদের কাছে কেউ মেয়ে বিয়ে দিতে চায় না। স্থানীয়রা আরো জানান, এলাকায় নেই স্কুল, নেই মসজিদ। কবর দেয়ার জন্য নেই কবরস্থান। কেউ মারা গেলে নিজ বাড়িতেই কবর দিতে হয়।
২০০৪ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকারের আমলে ৪৪ জন পেশাদার ডাকাত সাবেক এমপি আতাউর রহমান আঙ্গুরের মাধ্যমে প্রশাসনের কাছে আত্মসমর্পন করে। পরিচয় গোপন করে কথা হয় ডাকাতদলের এক সদস্যের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার বাপ-দাদারা ডাকাতি পেশায় আছিলো। হের লেইগ্যা আমরা জরাইয়া পড়ছি । ১৫ বছর বয়স থেইক্যা ডাকাতি শুরু করি। ২২ বছর বয়সে ডাকাত সর্দারের মেয়েকে বিয়ে করি । আমার বউও আমারে ডাকাতি কামে সহযোগিতা করে। চেষ্টা করছিলাম ভালা অইতে । পারি নাই। কোনহানো ডাকাতি অইলে দোষ পড়তো আমার। হের লেইগ্যা আর ছারবার পারি নাই ।
কথা হয় ডাকাতি পেশার সঙ্গে জড়িত আরেক জনের সঙ্গে। তিনি প্রথমে কথা বলতে রাজি না হলেও পরে বুঝানোর পর কথা বলতে রাজি হন। তিনি বলেন, এইডা আমাগো পেশা। আর ছারবার পারমুনা। রক্তের লগে মিশা গেছেগা। ডাহাতি কইরা বউ-বেডি লইয়া খাইবার পারি এইডাই শান্তি।
মরদাসাদী গ্রামের অন্য একজন ডাকাত বলেন, ১৭ বছর বয়স থেইক্যা তিনি ডাকাতি করে আসছেন। বর্তমানে তার বয়স ৬০ ছুঁই-ঁছুই। তিনি বলেন, ডাকাতি করা টেহার ভাগ পুলিশরে দিতে অয়। নাইলে পুলিশে জ্বালায়।
কথা হয় গ্রামের মুদি দোকানদার আবুল কাশেমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ডাহাতদের গেরাম অইলেও কেউ আমাগো গেরামে ডাহাতি করে না। হগ্গলতে বাইরে ডাহাতি করে।
ডাকাতদলের একজন বলেন, এ পেশাতন আমগো ফিরা আহন সম্ভব না। পোলাপাইনগো ইসকুলে নেয় না, পড়াইবার পারি না। তাই ডাহাইত না অইয়া উফায় কই।
এ ব্যাপারে কথা হয় আড়াইহাজার থানার অফিসার ইনচার্জ নজরুল ইসলামের সঙ্গে । তিনি বলেন, চেষ্টা চলছে এ পেশা থেকে সবাইকে ফিরিয়ে আনতে। আশা করছি পারবো । তবে ভালো হওয়ার সুযোগ দিতে হবে তাদের। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পুলিশ ভাগ পায় আমার জানা নেই। তবে এরকম হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে ।
নারায়নগঞ্জ-২ (আড়াইহাজার) আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ নজরুল ইসলাম বাবু বলেন, এখন ডাকাতি অনেক কমে গেছে। অচিরেই এ গ্রামে শান্তি ফিরে আসবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।