জুমবাংলা ডেস্ক : কাজী আসমা আজমেরি। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ট্রাভেলার্সদের মধ্যে অন্যতম এক নাম। দশ বছর ধরে তিনি বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের সংস্কৃতি, প্রকৃতি, দেশের মানুষ সম্পর্কে জানাচ্ছেন। ১১৫তম দেশ গ্রিসে লাল-সবুজের পতাকা উড়িয়ে কয়েক দিন আগে দেশে ফিরেছেন তিনি। এই নারী বিশ্বপর্যটকের লক্ষ্য চলতি বছরের ২৫ ডিসেম্বরের মধ্যে এক লাখ ছেলে-মেয়েকে তার গল্প শোনাবে।
একান্ত সাক্ষাৎকারে দেশের জনপ্রিয় একটি দৈনিক পত্রিকাকে আসমা আজমেরি জানালেন তার স্বপ্নের কথা। আসমা বললেন, আমি বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়েই পৃথিবীর সব দেশে আমার পায়ের চিহ্ন রাখতে চাই।
বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে বিশ্বভ্রমণের পরিকল্পনা প্রসঙ্গে আসমা আজমেরি জানান, তিনি ২০১০ সালে ভিয়েতনাম গিয়েছিলেন, ইচ্ছে ছিল সেখান থেকে কম্বোডিয়া যাবেন। কিন্তু ইমিগ্রেশনের লোকেরা তার রিটার্ন টিকেট নেই এবং বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেখে তাকে সে অনুমতি দেয়নি। সেদেশের ইমিগ্রেশন তাকে ২৩ ঘণ্টা জেলে বন্দি করে রাখে।
‘সেদিন আমি খুব কান্নাকাটি করেছিলাম। ওই ২৩ ঘণ্টা জেলে থাকার সময়ই আমি চিন্তা করলাম, আমাকে এমন কিছু করতে হবে যাতে বাইরের মানুষ বাংলাদেশের পাসপোর্টকে সম্মানের চোখে দেখবে, তাদের হয়রানি করবে না।’
সেই চিন্তা থেকেই বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে বিশ্বভ্রমণের চিন্তা মাথায় আসে তার।
ছোটবেলা থেকেই তিনি খুব দুরন্ত ছিলেন। ঘুরে বেড়ানোর স্বপ্ন ছিল তার। ছোটবেলা তার স্কুল জীবন কেটেছে খুলনায়। এর পর ঢাকার নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ করেছেন। সেসময় থেকেই তার বেড়ানো শুরু হয়।
তিনি ২০০৭ সালে প্রথম দেশ হিসেবে থাইল্যান্ড যাত্রা করেন। আর ২০১৮ সালে তুর্কমেনিস্তানের মাটিতে পা দিয়ে শততম দেশ সফরের আশা পূরণ করে রেকর্ড সৃষ্টি করেন তিনি।
আসমা আজমেরি বলেন, আমি জনপ্রিয়তার জন্য নয়, দেশ ভ্রমণ করি নিজের শখ থেকে।
প্রথম দিকে তার ভ্রমণটা ছিলো শখে তবে এখন তিনি অনুভব করেন তিনি তার ভ্রমণের মাধ্যমে নিজ দেশকে বিশ্বের বুকে তুলে ধরতে পারছেন। সেটা তাকে বেশ আনন্দ দেয়।
কাজী আজমেরি কালের কণ্ঠকে বলেন, আমার ইচ্ছে ছিল বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে ১০০টি দেশ ভ্রমণ করব, সেই ১০০টি দেশ ভ্রমণ করার পর আবার মনে হলো আমার মানুষের জন্য কিছু করা উচিত। যেটা সবসময়ই আমার ছোটবেলা থেকে একটি তাগিদ অনুভব করতাম। সেখান থেকে আবার ইচ্ছে হলো একটি সমাজ পরিবর্তন করার জন্য।
১০ থেকে ১৯ বছরের শিশুদের নিয়ে কাজ করছেন আসমা আজমেরি। তিনি বলেন, সমাজের এই শিশুদের যদি আমি নতুন কিছু শেখাতে পারি এবং পরিবর্তন করতে পারি তাহলে আমাদের সমাজে পরিবর্তন আসবে। সেখান থেকেই আমি ২০১৮ সাল থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চেঞ্জ মেকার এবং মোটিভেটর স্পিকার হিসেবে কাজ করে যাচ্ছি।
আসমা বলেন, আমার লক্ষ্য ২৫ ডিসেম্বর ২০২০ এর ভেতর এক লাখ ছেলে-মেয়েকে আমার গল্প শোনাবো এবং আমার গল্পের মাধ্যমে তাদের জীবনকে পরিবর্তন এবং মোটিভেটেড করার চেষ্টা করব।
‘এখানে আমার প্রধান শ্লোগান হচ্ছে, ট্রাভেলিং ইজ ফান ওয়ে টু লার্ন, ট্রাভেলিং ম্যাক ইউ মোর ওয়াইজার এন্ড এক্সপেক্টেবল এভরিথিং। ভ্রমণের মাধ্যমে পৃথিবীর সৌন্দর্য দেখে যে কোনো মানুষের মন বিশাল আকাশের মত বড় হয় এবং মানুষকে অনেক উদার করে। হিংসার মত সংকীর্ণতা দূর করবে। ভ্রমণকারী পারে পৃথিবীতে পরিবর্তন আনতে।’
তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি, আজকের শিশুরাই আগামী দিনের বাংলাদেশকে তাদের নতুন চিন্তা ভাবনা দিয়ে পরিবর্তন আনতে পারবে। আর তাদেরকে সুষ্ঠু শিক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের।
‘আমি অনেক রিচার্জ করে দেখেছি যে বাংলাদেশে এখন যারা শিক্ষকতা করে তারা অধিকাংশই পেটের দায়ে করে। ভালোবেসে, শ্রদ্ধা করে কেউ করেন না, এজন্য বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার মান অনেকটাই নোটের বইয়ের ভেতর আটকে গিয়েছে। সরকারের একার পক্ষে সম্ভব না পরিবর্তন করা যদি না আমি-আপনি পরিবর্তন না করি।’
ভ্রমণ যেন তার জীবনের একটি সংগ্রাম। তিনি প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করেছেন বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে কখনো বা সামাজিকভাবে কখনো বা পরিবারের দিক থেকে অথবা কখনো বা অর্থনৈতিক কখনো বা ভিসার দিক থেকে।
বাংলাদেশি নারী বিশ্বপর্যটক আসমা আজমেরি বলেন, আমার মনে হয় আমি ১৭ কোটি মানুষের চোখ দিয়ে পৃথিবীকে দেখি, এখন বিদেশে হাঁটি তখন আমি একজন ১৭ কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করি, ব্যবহার আমার আচার-আচরণ সবকিছুর মধ্যে দিয়েই বাংলাদেশ প্রকাশ পায়। যদি কখনো আমি খারাপ ব্যবহার করি তাহলে মানুষ বাংলাদেশকে খারাপ ভাববে, সাধারণ মানুষ একজনকে দিয়ে সেই দেশ কিংবা জনগোষ্ঠীকে বিচার করে।
‘আইফেল টাওয়ারের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হই না মুগ্ধ হই সেই ফ্রান্সের ছোট বো ধরে সাধারণ মানুষের ব্যবহার এবং তাদের আতিথেয়তায়, যেটা আমি হয়তোবা ইউটিউবে বসে কখনোই পাবো না। আইফেল টাওয়ার কিংবা স্ট্যাচু অফ লিবার্টির সৌন্দর্য আমি ইউটিউবে ঘরের মধ্যে বসে দেখতে পাবো, কিন্তু একটি দেশে যাওয়ার পর তার মানুষের আচার-আচরণ তা কখনোই জানতে পারব না। তাদের শিক্ষা তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা সব কিছুই জানতে হলে সেই দেশটিকে জানতে হবে সাধারণ মানুষের সাথে মিশতে হবে।’
তিনি এমন অনেক দেশে গিয়েছেন যেখানে বাংলাদেশকে লোকে চেনে না, ‘ইন্ডিয়া’ মনে করে। তখন আসমাকে বুঝিয়ে বলতে হয় যে বাংলাদেশ কোথায়।
ভ্রমণের খরচ প্রসঙ্গে তিনি জানান, এ জন্য পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরি করতে হয় তাকে। তিনি ২০১২ সালে নিউজিল্যান্ডে ছিলেন, তখন সেখানেও চাকরি করে ভ্রমণের টাকা জমিয়েছেন।
‘দুই বছর চাকরি করি আর ছয় মাস ঘুরি।’
ভ্রমণ যেন তার জীবনের একটি সংগ্রাম। তিনি প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করেছেন বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে কখনো বা সামাজিকভাবে কখনো বা পরিবারের দিক থেকে অথবা কখনো বা অর্থনৈতিক কখনো বা ভিসার দিক থেকে।
মাঝে মাঝে তার দিন শুরু হয় দৌড়ের মধ্য দিয়ে। ভিসার জন্য দৌড়াতে হয় অ্যাম্বাসিতে। তিনি আর দশটা বিদেশিদের মতো ইচ্ছা করলেই অনেক জায়গায় যেতে পারেন না। যেখানে সুইডিশ পাসপোর্টে ১৭৯টি দেশ ভ্রমণ করা যায় সেখানে বাংলাদেশি পাসপোর্টে ২৬টি দেশ ভ্রমণ করা যায়। তারপরও তিনি কখনো থেমে থাকেননি। সংগ্রাম করেছেন অজানাকে দেখার উদ্দেশ্যে এবং সংগ্রাম করেছে নিজের স্বাধীনতার জন্য।
বিশ্ব ভ্রমণে আনন্দময় ঘটনার পাশাপাশি আসমা আজমেরী নিরানন্দময় ঘটনারও সম্মুখীন হয়েছেন। ২০০৯ সালে ভিয়েতনামে রিটার্ন টিকিট না থাকায় ২৩ ঘণ্টা জেলে থাকতে হয়েছে তাকে। ২০১০ সালের ২৪ এপ্রিল এবং মে মাসের প্রথম সপ্তাহে সাইপ্রাসে দু-দুবার জেল খেটেছেন তিনি। এছাড়া ২০১৭ সালের ৪ আগস্ট কিউবায় তার ট্রাক্সির সঙ্গে স্কুটির সংঘর্ষও হয়েছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।