জুমবাংলা ডেস্ক : বিশ্বের সবচেয়ে বড় বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা স্বাধীনতা পদকসহ দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষার অগ্রগতি, কৃষি, খাদ্য, নারী উন্নয়নসহ নানা বিষয়ে অবদানের জন্য দেশে-বিদেশে সর্বোচ্চ সম্মাননা ও খেতাব পেয়েছেন তিনি। প্রায় সাতচল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ব্র্যাকের সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার পর চলতি বছরের আগস্টে চেয়ারম্যান পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। হন ব্র্যাকের চেয়ার ইমেরিটাস।
১৯৩৬ সালের ২৭ এপ্রিল ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত হবিগঞ্জের বানিয়াচং-এ জন্মগ্রহণ করেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। আর রাজধানীর একটি হাসপাতালে শুক্রবার রাতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কয়েক মাস আগে তার দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব নবনীতা চৌধুরী। সেই সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-
নবনীতা চৌধুরী: বাংলাদেশে আমরা কাউকে এত বড় প্রতিষ্ঠান বানাতে দেখি না, আবার অবসরেও যেতে দেখি না। কী করে আস্থা পেলেন যে, ব্র্যাকের লক্ষাধিক কর্মী এবং এর তেরো কোটির বেশি সুবিধাভোগীদের কোনো অসুবিধা হবে না আপনার অনুপস্থিতিতে।
ফজলে হাসান আবেদ : আমি বহুদিন থেকে ব্র্যাকে আমার পরে কারা নেতৃত্বে আসবে সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা করেছি এবং আমার মনে হয়, এখন নেতৃত্বে দেখতে পাচ্ছি তারা সুচারুভাবেই আমার কাজকর্ম এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন আগামীতে। এটা আমি বিশ্বাস করি। যারা নেতৃত্বে আসছেন তাদের দক্ষতাও তৈরি হয়েছে। ব্র্যাক আমার পরে যাতে আরও ভালোভাবে চলে সেটা আমি চাই।
নবনীতা চৌধুরী: চার দশক ধরে আপনি ভাবছেন বিদেশি সাহায্যের থেকে বেরিয়ে কী করে ব্র্যাক নিজের আয়ে স্বাবলম্বী হয়ে উন্নয়নকাজ চালিয়ে যেতে পারবে। আড়ং করেছেন, ব্যাংক আছে, বিকাশ – এই প্রতিষ্ঠানগুলোর লাভের টাকা দিয়েই ব্র্যাকের সত্তর শতাংশ খরচ চলছে। এই মডেলটা কীভাবে মাথায় এল?
ফজলে হাসান আবেদ : এই মডেলটা ঊনিশশ পঁচাত্তরের দিকে এসেছিল, বোধ করি। হঠাৎ করে (ভারতে) ইন্দিরা গান্ধী ইলেকশন বন্ধ করে দিয়ে জরুরি অবস্থা জারি করলেন। বিদেশ থেকে টাকা পাওয়ার জন্য সরকারি অনুমোদন নেওয়ার নিয়ম করা হলো। আমি বুঝতে পারলাম, ভারত যখন করেছে এটা বাংলাদেশেও আসবে। তখন বাংলাদেশে সামরিক শাসন আরম্ভ হচ্ছে। ভাবলাম, পরে বিদেশ থেকে টাকা পাওয়া কঠিন হবে। আমাদের এখানেই কিছু অর্থকরী কাজকর্ম শুরু করা দরকার যাতে বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল না থাকি। সে জন্য প্রথমে আড়ং তৈরি হলো, তারপর ব্র্যাক প্রিন্টার্স তৈরি হলো, এ রকম করে ছোট ছোট বিজনেস তৈরি হলো যা থেকে কিছু কিছু মুনাফা আসতে লাগল। আমরা কাজ চালিয়ে যেতে লাগলাম। যদিও আমাদের বিদেশি সাহায্য একেবারে লুপ্ত হয় নাই, সব সময়ই আসছে কিন্তু তবুও আমরা পরনির্ভরশীলতা থেকে কিছুটা বেরিয়ে আসলাম।
নবনীতা চৌধুরী: ব্র্যাক যেহেতু কমিউনিটির সঙ্গে মিলে স্থানীয় মানুষের প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে তাদের সঙ্গে মিশে কাজ করেছে, ব্র্যাকের ব্যবসাগুলো সেভাবে উদ্ভব হলো। উত্তরবঙ্গের খামারিরা দুধ রাস্তায় ফেলে দিচ্ছে তখন আপনি আড়ং ডেইরি করলেন।
ফজলে হাসান আবেদ : ব্র্যাকের ব্যবসাগুলোকে আমরা বলতাম প্রোগ্রাম সাপোর্ট এন্টারপ্রাইজ। আড়ংটা যখন হয়েছিল তখন সেটি বিজনেস হিসেবে আসে নাই। যারা গ্রামেগঞ্জে কারুকাজ করে- তাদের কারুপণ্য বিক্রি করার ব্যবস্থা নাই। আমরা যদি ঢাকায় ব্যবস্থা করি, তাতে অন্তত কারুপণ্য যারা তৈরি করে তাদের একটা বিপণন ব্যবস্থা হবে। এটা সাফল্য লাভ করেছে, কিছু কিছু মুনাফাও আসছে। আমাদের প্রোগ্রামই ছিল গ্রামের দরিদ্র মানুষের আয়বধর্ক কাজে সহযোগিতা করা এবং তাদের আমরা ট্রেনিং দিয়েছি, ডিজাইন দিয়েছি, অনেক রকমের সহায়তা দিয়েছি, যাতে করে তারা নিজেরা কাজ করে আয় বাড়াতে পারে এবং সেটাই হচ্ছে।
নবনীতা চৌধুরী: আগে সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাংক ততটা পৌঁছাতে পারেনি, নিরাপদে টাকা লেনদেনে তাদের কোনো সুযোগ ছিল না। ব্র্যাক বিকাশের উদ্ভাবন নিয়ে গেল সাধারণ মানুষের কাছে, এখন বাংলাদেশের মোবাইল ব্যাংকিং-এরই আরেকটা নাম হয়ে গেছে বিকাশ। বিকাশ, আড়ং ডেইরি এগুলোর কোনোটিতেই আপনার বা আপনার পরিবারের মালিকানা নাই…
ফজলে হাসান আবেদ : না।
নবনীতা চৌধুরী: এ প্রতিষ্ঠানগুলো টিকে যাবে এভাবেই?
ফজলে হাসান আবেদ : এভাবেই টিকবে। প্রতিষ্ঠানগুলো টিকবে। প্রতিষ্ঠানের মালিকানা তো ব্র্যাকের কাছে। সব আয় আসবে নন প্রফিট অর্গানাইজেশনের কাছে এবং আমরা এ টাকা দিয়ে আমাদের প্রোগ্রাম চালাব। আমাদের কর্মসূচি, বিভিন্ন কাজ চলবে।
নবনীতা চৌধুরী: আমরা ভাবি যে, উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক আড়ং, ব্যাংক ও বিকাশ দিয়ে এক রকমের ব্যবসা করছে?
ফজলে হাসান আবেদ : বেশির ভাগ মানুষ বোঝে না। নন প্রফিট অর্গানাইজেশন কনসেপ্টটা বোঝে না অনেকে, যে কোনো একটা সংগঠন তার কোনো মালিকানা নাই, এই জিনিসটাই বোঝে না।
নবনীতা চৌধুরী: কীভাবে সম্ভব যে কোনো মালিকানা নাই? ফজলে হাসান আবেদের প্রতিষ্ঠান না, তাহলে কার?
ফজলে হাসান আবেদ : প্রতিষ্ঠানটি জনগণের। এই প্রতিষ্ঠানের মালিক কোনো একক ব্যক্তি নয়। একটা নন প্রফিট, মানে এটার কোনো প্রফিট হবে না। যেই ইনকাম হবে এটা দিয়ে জনগণের স্বার্থে কাজ হবে। অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না। কোনো পার্সোনাল কাজে ব্যবহার করা যাবে না।
নবনীতা চৌধুরী: ব্র্যাকে এক লাখের মতো কর্মী, কেউ বলছেন ১১ কোটি, কেউ বলছেন ১৩ কোটি বেনিফিশিয়ারি, কে ঠিক করেন যে, কার কীসে, কোন কমিউনিটির কীসে সুবিধা হবে এবং কী কাজ করতে হবে?
ফজলে হাসান আবেদ : এটা বেসিক্যালি আমাদের পরিচালনা পরিষদ ঠিক করেন যে, কী কী কাজ হবে। আর যারা অর্গানাইজেশন চালান, তারা সেটা করেন। পরিচালনা পরিষদের একটা দায়িত্ব আছে যে, কী কী কাজ আমরা করব আগামীতে। যারা আমাদের সংস্থা পরিচালনা করেন, তারা সেগুলো বাস্তবায়িত করেন।
নবনীতা চৌধুরী: যেটা বলছিলাম যে, তার মানে কি একটা সফল বিজনেস মডেল ছাড়া এখন সামাজিক উন্নয়ন সংস্থা বা সামাজিক উন্নয়নকাজেও সফল হওয়া সম্ভব নয়?
ফজলে হাসান আবেদ : অনেক টাকা বিদেশ থেকে আসে। যারা অনেক কোটিপতি লোক আছে, যারা দান করেন। অনেক দেশ আছে যারা দান করে অন্যান্য গরিব দেশে। ওই সব দেশ থেকে টাকা আসে। এসব দেশের টাকা ছাড়াও আমরা যদি নিজের দেশে কিছু, নিজেরা কিছু জোগাড় করতে পারি বিজনেসের মাধ্যমে, এটা একটা এডিশনাল, উপরি পাওয়া। নিজের যদি কিছু আয় থাকে, সেটা দিয়ে অনেক এক্সপেরিমেন্ট করা যায়। করে যদি খুব ভালো হয় তাহলে বিদেশ থেকে টাকা পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। আপনি যদি দেখাতে পারেন যে, এই কর্মসূচি খুব সফল এবং এটা যদি আরও বেশি টাকা পাওয়া যায় এটাকে আরও বাড়ানো যায়। আমরা যদি এখন নারী-পরুষ সমতায় একটা ভালো কিছু দেখাতে পারি বাংলাদেশে, তাহলে হয়তো- আমরা হয়তো খরচ করলাম এখানে একশ কোটি টাকা কিন্তু আমি আরও এক হাজার কোটি টাকা আনতে পারব, যদি দেখাতে পারি বাংলাদেশে নারী-পুরুষ সমতা সত্যিই এগোচ্ছে।
নবনীতা চৌধুরী: আলট্রা-পুওর গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রাম, চরম দারিদ্র্য থেকে উত্তরণের যে মডেল ব্র্যাক তৈরি করেছে, সেটা দক্ষিণ সুদান, ফিলিপাইন, উগান্ডাসহ অনেক দেশে সরাসরি অনুসৃত হচ্ছে। এটা কি ব্র্যাক নামে পেটেন্টেড, মানে ব্র্যাকের নামেই চলছে…
ফজলে হাসান আবেদ : সবাই জানে এটা ব্র্যাক তৈরি করেছিল। আমরা যে এটা পেটেন্ট করে বসে আছি তা না। আমরা চাই সবাই এটা ব্যবহার করুক। সেটা থেকে আমরা কিছু চাচ্ছি না। আমরা চাই যে, দরিদ্র লোক তাদের জীবনমান উন্নত করুক। সেটা তো আমরা চাই, এটা তো আমরা বিজনেস হিসেবে দেখছি না।
নবনীতা চৌধুরী: ব্র্যাকের পরামর্শ মেনেই এই মডেলটা অনুসৃত হচ্ছে?
ফজলে হাসান আবেদ : ব্র্যাক দুটো জিনিস করছে। টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট পরামর্শ আর টাকা জোগাড় করা। সেসব দেশে টাকা জোগাড় করতে পারছে না, আমরা ওয়ার্ল্ড ব্যাংকে যাচ্ছি, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে যাচ্ছি, আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে যাচ্ছি। আমরা তাদের কিছু টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্টও দিচ্ছি এবং অ্যাডভোকেসিও করছি ফর ফান্ডিং। যাতে করে তারা টাকাটা পায়।
নবনীতা চৌধুরী: রিসার্চের প্রসঙ্গে যদি ওরস্যালাইনের কথা বলি- এক মুঠো গুড়, এক চিমটি লবণ এই ফর্মুলা ব্র্যাকের আবিষ্কার নয় কিন্তু এই ফর্মুলাটা ঘরে ঘরে গিয়ে শেখাল। নেমে আসবে শিশুমৃত্যুর হার। সেই উদ্ভাবনটা তো ব্র্যাকের, সেটা কী করে সম্ভব হলো?
ফজলে হাসান আবেদ : প্রথম দিকে আমরা ২-৩টা থানায়, উপজেলায় কাজ করেছি। ওখানে আমরা অনেকগুলো প্রবলেম সলভ করেছি। তারপর আস্তে আস্তে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে এবং আমরা সব সময়ই দেখেছি, খালি শেখালেই হয় না। একজন মাকে আপনি শেখালেন, সে ব্যবহার করছে কি না সেটা দেখতে হবে। সে সঠিকভাবে ব্যবহার করছে কি না সেটাও দেখতে হবে। তার যে লবণ-গুড়ের স্যালাইন বানালো সেটার কার্যকারিতা আছে কি না সেটাও দেখতে হবে। এইগুলো আমরা কন্টিনিউয়াসলি মনিটর করেছি এবং দেখেছি যে, এগুলো কার্যকর এবং তখন এটাকে সারা দেশে ছড়ানো হয়েছে।
নবনীতা চৌধুরী: আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানসহ ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনাল যেসব জায়গায় কাজ করেছে- ব্র্যাকের দক্ষ কর্মীরা সেখানে স্থানীয় মানুষের মাঝে কর্মী তৈরি করেছে, ফিরে এসেছেন। এই রকম একটি দক্ষ কর্মীবাহিনী গড়ে তোলা আসলে সম্ভব হলো?
ফজলে হাসান আবেদ : একটা হলো দক্ষতা বাড়ানো, আরেকটা নিজের দেশের জন্য কাজ করার একটা মোটিভেশন- এটা তৈরি করা যে, আমি আমার দেশের জন্য কী কাজ করছি। এটা আমি অনেক দেশে দেখেছি যে, আমাদের দেশে, বাংলাদেশে কিন্তু কর্মীরা নিজের দেশের জন্য কাজ করতে বেশ আগ্রহ প্রকাশ করে এবং করেও কাজ। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে। আফ্রিকাতে দেখেছি চারটা বেজে গেলেই কাজ হয়ে গেছে- শেষ। ওই মোটিভেশনটা কম। এইটা যাতে বাড়ানো যায় … এটার খুব দরকার। একটা দেশের উন্নতির জন্য যদি তার নিজের জনগণ সক্রিয় না হয় তাহলে তো উন্নতি বেশি হয় না।
নবনীতা চৌধুরী: বাংলাদেশে আমরা অনেকেই মনে করি যে এই সিস্টেমের ভেতর দুর্নীতিমুক্ত একটা ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব না। দুর্নীতিমুক্তভাবে গড়ে তুললেন কী করে? ধরুন অর্থনীতি হিসাবপত্র, অডিট যদি ঠিক না থাকত এইখানে যদি কাজের নিরাপত্তা না থাকত- এমনকি ধরুন যৌন হয়রানির বিচারের ব্যবস্থা যদি এই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে না থাকত, ব্র্যাক তো এত সহজে একটা আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডও হয়ে উঠতে পারত না?
ফজলে হাসান আবেদ : সব সময় আমি একটা ভালো সংগঠন তৈরি করতে চাচ্ছিলাম এবং এ সংগঠনের ভেতরে কী হচ্ছে, কি না হচ্ছে সে সমস্ত জিনিস লক্ষ্য করেছি… উন্নত করার চেষ্টা করেছি। এইগুলো প্রথম থেকেই ছিল। নিয়মতান্ত্রিক একটি সংগঠন তৈরি করা। যাতে কেউই মনে না করে যে, আমার প্রতি সুবিচার করা হচ্ছে না।
নবনীতা চৌধুরী: নিয়মতান্ত্রিক একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে আসলে কী কী ব্যবস্থা নিতে হয়েছে?
ফজলে হাসান আবেদ : কঠিন চর্চা, কঠিন নিয়মকানুন থাকতে হবে… কে কাকে সুপারভাইজ করবে, কতক্ষণ সুপারভাইজ করবে। আমাদের স্কুলে কোন সুপারভিশন হয়, সপ্তাহে কদিন যায়, কতক্ষণ থাকে, কী দেখে।…একটা টিচার তার লেসনপ্ল্যান নিয়ে আসল কি না সেটাও চেক করে.. । চেকলিস্ট আছে। কী কী জিনিস দেখতে হবে…
নবনীতা চৌধুরী: ব্র্যাকের কাজ তো শুরু সেই ১৯৭২-এ .. ব্র্যাক রিহ্যাবিলিটেশন কমিটি নাম দিয়ে। আপনি এলেন পুনর্বাসনের কাজ করতে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে- সুনামগঞ্জের একটা ছোট্ট গ্রামে।
ফজলে হাসান আবেদ : শুধু একটা গ্রামে না .. দুইশ গ্রামে।
নবনীতা চৌধুরী: সুনামগঞ্জের দুইশ গ্রামে কাজ শুরু করলেন। তারপর নাম বদলালো – ব্র্যাক। ‘রুরাল অ্যাডভান্সমেন্ট কমিটি’ হলো তার মানে পল্লি উন্নয়নের কাজ করছেন …
ফজলে হাসান আবেদ : তারপরে ব্র্যাক হয়ে গেল।
নবনীতা চৌধুরী: নাম বদলেছে … তার ধরনও কি বদলেছে কি না? মানে তার কাজের পরিধি বাড়িয়েছে?
ফজলে হাসান আবেদ : কাজের পরিধি বেড়েছে, অনেকরকম কাজও বেড়েছে আর প্রধানত দারিদ্র্য বিমোচন … দারিদ্র্য তো এক জিনিস নয়… দারিদ্র্যের বহুমাত্রিকতা আছে- পুষ্টি, ক্ষুধা, শিক্ষার সুযোগ… অনেক ধরনের সুযোগ নাই দরিদ্রদের। এই সুযোগগুলো তৈরি করা। দারিদ্র্যের বহুমাত্রিকতা নিয়ে আমরা কাজ করছি।
নবনীতা চৌধুরী: এই কাজগুলো যখন ব্র্যাক করছে, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর শাসন আমলে শুরু … তারপর বঙ্গবন্ধু তো নিহত হলেন… এক রকমের দেশ একটা অনিশ্চয়তায় পড়ল… সামরিক শাসন এল প্রেসিডেন্ট জিয়া, এরশাদের আমল তারপর ৯০- পরবর্তী গণতান্ত্রিক আমল কিন্তু ব্র্যাক তো তার কাজ থামাতেও হলো না এবং পিছিয়েও পড়ল না। রাজনৈতিক উৎসাহ সদিচ্ছা আসলে কতটুকু প্রয়োজন তাহলে?
ফজলে হাসান আবেদ : রাজনৈতিকভাবে আমাদের কোনো বাধা দেওয়া হয় নাই। যে সরকারই এসেছে, সব সরকারের সঙ্গে আমরা কাজ করতে রাজি ছিলাম এবং করেছিও। মোটামুটি ভালোই সাপোর্ট পেয়েছি। কোনো অসুবিধা হয় নাই।
নবনীতা চৌধুরী: কাজের পরিধির জন্য একটা কথা প্রচলিত যে, ব্র্যাক আসলে সরকারের সমান্তরাল একরকমের প্যারালাল গভর্নমেন্ট। আসলে তো ব্র্যাক সে কাজ করে নাই, সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে?
ফজলে হাসান আবেদ : সব সময় সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে এবং আমাদের জনগণের জন্য কাজ করেছে। আমরা কিন্তু সরকারের জন্য কাজ করি নাই। আমরা সব সময় বাংলাদেশের জন্য কাজ করেছি। তাই তো। এইটা আমাদের দেশ। কাজেই আমরা যে সরকারের সহযোগী হিসেবে কাজ করছি … আমরা আমাদের দেশের জন্য কাজ করছি।
নবনীতা চৌধুরী: আপনি প্রায় পঞ্চাশ বছর একদম বাংলাদেশের তৃণমূলে কাজ করলেন। কোনগুলোকে আপনি আপনার বড় অর্জন বলে মনে করেন যে, এই ক্ষেত্রগুলোতে বড় অর্জন হয়েছে?
ফজলে হাসান আবেদ : আমার মনে হয় শিক্ষায় আমাদের অর্জন ভালো। জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি যদি সাকসেসফুল না করতে পারতাম তাহলে আমাদের জনসংখ্যা আরও অনেক বাড়ত এবং আমাদের জনসংখ্যা বাড়লেই যে আমাদের জনপ্রতি আয় আরও কমে যেত। আমরা এখন প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ কিন্তু আমাদের জনসংখ্যা যদি আরও দুইশ মিলিয়নের ওপর হতো বা ২০ কোটির ওপরে হতো তাইলে আমাদের খাদ্যে ঘাটতি হতো। এই সব জিনিস তো আমরা এড়াতে পেরেছি।
নবনীতা চৌধুরী: যদি আপনার জীবনের কথাই পড়ি, একটা তীব্র দেশপ্রেম দেখি। আপনি ব্রিটেনে লেখাপড়া করেছেন, একদম সুটেড-বুটেড সাহেব। বিদেশি তেল কোম্পানিতে কাজ করেন। ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থানের প্রতিবাদ জানিয়ে একদম লিখিতভাবে পদত্যাগ করলেন। তারপর লন্ডনে গেলেন, গিয়ে আপনি স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য অর্থ সংগ্রহ করছেন। শুধু তাই করছেন না, আপনি আবার তখন বিদেশি মার্সেনারি মানে আক্রমণকারীদের সঙ্গেও যোগাযোগ করলেন। তারা আপনার কাছ থেকে টাকা নিয়ে করাচিতে কয়েকটা জাহাজ ডুবিয়ে দিতে পারে কি না। আবার আপনি তখন ভাবলেন যে, বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে একটা পরামর্শ করে নেওয়া দরকার। মানে এই যে দেশপ্রেম, আবার ওই বয়সে, একটা বিবেচনাবোধ একটা প্রাতিষ্ঠানিকতার প্রতি আস্থা। এই গুণগুলো আপনি কোথায় পেলেন?
ফজলে হাসান আবেদ : কোথায় পেলাম? এটা আমার মধ্যেই ছিল, জাগ্রত। তবে আমি মনে করি নাই যে, আমি একা, আমাদের প্রধানমন্ত্রী একজন আছে, তার কাছে কোনো কিছু না বলে আমি নিজে নিজেই করে ফেলব… আমার ধারণা যে, তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে নিশ্চয়ই এটা আলাপ না করে করা উচিত নয়।
নবনীতা চৌধুরী: আপনি ১৯৭০ সালে প্রথম সাধারণ মানুষের কাজে লাগতে গেলেন। মনপুরায় তখন লাখ লাখ মানুষ নিহত হয়েছেন, সেখানে আপনি গেলেন, তাদের ঝড়ে ভেঙে যাওয়া বাড়িঘর তৈরি করে দিতে। এই যে এবং ৭১-এর পর আপনি এলেন আসলে শরণার্থী মানুষজন- যুদ্ধবিধ্বস্ত বাড়িঘর ঠিক করে দিতে। তারপর আপনি রয়েই গেলেন আসলে। মানে সেই সময়ে একটা শেল কোম্পানির চাকরি, আপনি একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট সেটা থেকে আপনি সাধারণ মানুষের জন্য…
ফজলে হাসান আবেদ : এই কাজ তো আরও সুন্দর, আরও ভালো। আমি অনেক স্যাটিসফেকশন পেলাম তো। আমার জীবন তো সার্থক হলো আমার নিজের দেশের লোকের জন্য কাজ করে।
নবনীতা চৌধুরী: জীবনকে সার্থক মনে হয়?
ফজলে হাসান আবেদ : হুম। আমি তো সার্থক মনে করি যে, আমি দেশের জন্য কাজ করতে পেরেছি। আমাদের দরিদ্র জনগণের জন্য কাজ করতে পেরেছি আমি তো সার্থক মনে করি।
নবনীতা চৌধুরী: এখন তরুণ প্রজন্মকে আমরা দেখি যে প্রায়শই তারা ব্যক্তি উদ্যোগে মানুষের কাজে লাগতে চান। কিন্তু তারা ভাবেন যে, একার উদ্যোগ বা আমার কয়েকজন বন্ধুর উদ্যোগে আসলে কি লাভ হবে? আপনার তাদের জন্য কোন পরামর্শ আছে কি না। কীভাবে আসলে নিজেদের ছোট ছোট উদ্যোগ দিয়ে কোটি মানুষের কাজে লাগা যায়?
ফজলে হাসান আবেদ : ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোগকে একসঙ্গে করলে এটার ইম্প্যাক্টটা বেশি হয়। আমি ক্ষুদ্র উদ্যোগের পক্ষে নই। আমি মনে করি স্মল ইজ বিউটিফুল বাট একটা বড়সড় কর্মসূচি না হলে এটার ইম্প্যাক্ট দেখতে পাই না আমাদের সমাজে।
নবনীতা চৌধুরী: আপনার কাজটা হচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচনে তীব্র একটা রূঢ় বাস্তবতার সঙ্গে কাজ। আবার আপনি রবীন্দ্র অনুরাগী। শিল্পকর্মের উৎসাহী মানে সংগ্রাহক। এই যে শিল্প-সাহিত্য সৌন্দর্যের পাঠ আপনাকে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে কোনো বাধা দেয় কি না?
ফজলে হাসান আবেদ : নাহ্, শক্তি জোগায়। রবীন্দ্রনাথ তো আমার খুবই প্রিয়। রবীন্দ্রনাথের মতো এ রকম একজনের একটা বিরল প্রতিভা আমাদের সেন্সসিবিলিটির জায়গাটাকে অনেক বড় করে দিয়েছে।
নবনীতা চৌধুরী: এমন কোনো গান, পঙ্ক্তি বা প্রার্থনা আছে যেটা প্রতিদিন স্মরণ করেন?
ফজলে হাসান আবেদ : তা নাই হয়তো। রবীন্দ্রনাথের গান সব সময়ই ভালো লাগে। অনেক রকমের গান তো তার, এক রকমের তো না। গানই ভালো লাগে সবচেয়ে বেশি, কবিতাও ভালো লাগে। গান শুনি বেশি। কবিতাও আওড়াতে পারি।
নবনীতা চৌধুরী : আপনার স্ত্রী আয়েশা আবেদ, তিনি ৭২-সাল থেকে ব্র্যাকের সঙ্গে একদম সক্রিয় ছিলেন। আড়ং গড়ে তোলার কাজটা তার হাত দিয়েই হলো। ৮১-সালে তিনি যখন মারা গেলেন, আপনার দুই সন্তান তখন খুবই ছোট। এরপর আমি আপনার জীবনী বা অন্যান্য সাক্ষাৎকারে পড়েছি, আপনি যেহেতু সব সময় বেতনভুক্ত ছিলেন, আপনার একরকম অর্থনৈতিক অসামর্থ্য তারা আপনার ভাইবোনের দেওয়া টাকায় আসলে পড়ে এল বিদেশ থেকে। এসে ওরা আবার ব্র্যাকেই কাজ করছেন। এমন একটা কাজে বিশ্বাসী পরিবার কীভাবে গড়ে তুলতে পারলেন আপনি?
ফজলে হাসান আবেদ : ওরা নিজেরাই জোর করেছে। আমই কখনো বলি নাই তোমরা এখানে এসে কাজ কর। ওদেরই মনে হয়েছে যে এটা আমাদেরই কাজ, আমরাই করব। আমি কখনো ওদেরকে বলি নাই যে, আমি চাই তোমরা এসে এখানে কাজ কর। নিজেরাই ঠিক করেছে যে এখানে কাজ করলে হয়তো কিছু করা যাবে, কিছু লোককে সহায়তা করা যাবে সেভাবেই ওরা জয়েন করেছে, ওরা হয়তো মনে করেছে যে, এই কাজ যেটা ওরা নিয়েছে, তার থেকে ওরা সবচেয়ে বেশি আনন্দ পাবে। আমার মনে হয়, আমার দুই ছেলেমেয়েই তাদের কাজে খুবই সংযুক্ত আছে, খুব দৃঢ়ভাবে সংযুক্ত। এবং আমার মনে হয়, তারা সারা জীবনই এই কাজে থাকবে।
নবনীতা চৌধুরী: ২০৪১ সালে আমরা উন্নত দেশ হবে বলছি, কী চেহারা দেখেন বাংলাদেশের এবং ব্র্যাকের প্রধানত কোন কাজগুলোর দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত?
ফজলে হাসান আবেদ : ব্র্যাকের সবচেয়ে আমি যেটা বললাম আর্লি চাইল্ডহুড এখন যে ইয়ে হচ্ছে, প্লেবেজড লার্নিং ইট উইল হ্যাভ এ বিগেস্ট ইমপ্যাক্ট অন দ্য সোসাইটি ইটসেলফ বাই ক্রিয়েটিং সোশ্যাল অ্যান্ড ইমোশন ইন ইন্টেলিজেন্স পিপল। জনগোষ্ঠীর ক্যারেক্টার চেঞ্জ হবে, এটা আমি মনে করি।
নবনীতা চৌধুরী: সেটাই হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, স্যার ফজলে হাসান আবেদ।
ফজলে হাসান আবেদ : থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।