আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে হত্যা বন্ধ করা কঠিন নয়। কিন্তু সরকারকে আগ্রহী হতে হবে। বলছে ভারতের মানবাধিকার সংগঠনগুলি। খবর ডয়চে ভেলের।
ঠিক দশ বছর আগে ৬ জানুয়ারি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারে ঝুলে ছিল কিশোরী ফেলানীর মৃতদেহ। বিএসএফ-এর গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল তাঁর দেহ। ১০ বছর পর বিচার পয়েছে ফেলানির পরিবার? বাংলাদেশের জন্মের পঞ্চাশ বছর পরে ঠিক কী অবস্থায় আছে দুই দেশের সীমান্ত? কতটা আতঙ্কে সীমান্তের মানুষ?
”পরিস্থিতি ভয়াবহ।” ছোট্ট বাক্যে পরিস্থিতি বর্ণনা করতে শুরু করলেন ভারতের মানবাধিকার কর্মী কিরীটি রায়। তাঁর সংস্থার নাম মাসুম। ফেলানী হত্যার পরে কিরীটিবাবুর উদ্যোগেই প্রথমে হাইকোর্টে এবং পরে সুপ্রিম কোর্টে বিএসএফ-এর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। সেই মামলা এখনো চলছে। সাত বছর ধরে তা পরে আছে সুপ্রিম কোর্টে। এখনো বিচার পায়নি ফেলানীর পরিবার। মধ্যবর্তী সময়ে আরো অনেক ফেলানী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন দুই বাংলার সীমান্তে।
কিরিটিবাবুর বক্তব্য, ”বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলি এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্ট অনুযায়ী গত দশ বছরে সীমান্তে দুই হাজার ৬৩২ জন বাংলাদেশি নাগরিককে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের হিসেব, প্রতি বছর প্রায় দেড়শো জন করে মানুষকে সীমান্তে হত্যা করা হয়। এর বহু ঘটনাই হারিয়ে যায়। দেহ লোপাট হয়ে যায়। আমাদের রিপোর্ট বলছে, যে পরিমাণ সীমান্ত হত্যা হয়, তার আশি শতাংশ ভারতীয় নাগরিক। বিএসএফ যাদের গরুপাচারকারী বা স্মাগলার বলে গুলি করে দেয়। অথচ এ নিয়ে এ দেশে কেউ কোনো কথাই বলেন না।”
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা একাধিক মানবাধিকার সংগঠনের বক্তব্য, এ বিষয়ে বিএসএফকে প্রশ্ন করলেই তারা বলে, পাচারকারীরা তাদের আক্রমণ করেছিল। সে কারণেই আত্মরক্ষার জন্য তারা গুলি করতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু বাস্তব অন্যরকম। ফেলানীর ঘটনাতেই প্রমাণিত, তাঁর কাছে কোনো অস্ত্র ছিল না। বিএসএফ-কে আক্রমণের প্রশ্ন তো অনেক পরের। ‘ট্রিগারহ্যাপি সীমান্তরক্ষী’ গুলি চালানো অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছে।
কিরীটিবাবুর অভিযোগ, মাসখানেক আগেও ১৬ বছরের একটি ছেলেকে বিএসএফ ধরে থানায় নিয়ে গিয়ে অত্যাচার চালায়। তারপর গুলি করে হত্যা করে। অথচ এই অধিকার তাদের নেই। মানবাধিকারকর্মীদের দাবি, পাচারকারীর শাস্তি স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে ভারতীয় দণ্ডবিধিতে। পাসপোর্ট আইন অনুযায়ী বিনা কাগজপত্রে কোনো ভারতীয় বা বিদেশি নাগরিক সীমান্তে ধরা পড়লে তাঁর সর্বোচ্চ তিন বছরের সাজা হওয়ার কথা। হত্যার কোনো জায়গাই নেই সেখানে। অথচ বাস্তবে ঠিক তার উল্টোটাই ঘটে।
বিএসএফের কর্মকর্তারা অবশ্য এ কথা মানতে রাজি নন। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিএসএফ কর্মকর্তা ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, চোরাপাচারকারীদের সঙ্গে অস্ত্র থাকে। তারাও বিএসএফকে আক্রমণ করে। ফলে বাধ্য হয়েই গুলি চালাতে হয়। তবে যে পরিমাণ সীমান্ত হত্যার অভিযোগ মানবাধিকার সংগঠনগুলি করে, বিএসএফ তা মানতে রাজি নয়। বরং তাদের বক্তব্য, সীমান্তে যথেষ্ট বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহারই তারা করে।
বাস্তব যে খুব বন্ধুত্বপূর্ণ নয়, তা অবশ্য সীমান্তে বসবাসকারী মানুষদের সঙ্গে কথা বললেই বোঝা যায়। পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা সীমান্তে বসবাসকারী এক ভারতীয় নাগরিকের বক্তব্য, ”বিএসএফ প্রতিদিন সীমান্তবর্তী গ্রামে অত্যাচার চালায়। বিভিন্ন পাচারের সঙ্গে তারাও যুক্ত। অথচ গ্রামের মানুষদের উপর তারা অত্যাচার চালায়। পাচারকারী তকমা লাগিয়ে দেয়।”
সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তে গরুপাচারের সঙ্গে যুক্ত সন্দেহে বিএসএফ অফিসারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কীভাবে সীমান্তে বিভিন্ন চক্রের সঙ্গে ওই অফিসার এবং তাঁর পরিবার যুক্ত ছিল, তা প্রকাশ করেছে সিবিআই।
ভারতীয় সেনা বাহিনীর সাবেক লেফটন্যান্ট জেনারেল উৎপল ভট্টাচার্য ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ”ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে গত ৫০ বছর ধরেই অনুপ্রবেশ একটি বড় সমস্যা। অনুপ্রবেশ এবং পাচারের সঙ্গেই সীমান্ত হত্যার বিষয়টি জড়িত। দুঃখজনক ভাবেই বহু মানুষের প্রাণ গিয়েছে সীমান্তে। তবে আমার মনে হয়, আগের চেয়ে বিষয়টি কিছুটা কমেছে। কারণ, পাচারও কমেছে। অনুপ্রবেশও আগের চেয়ে কমেছে।” উৎপলবাবুর বক্তব্য, দুই দেশের সরকার যদি এ বিষয়ে নিয়মিত আলোচনা জারি রাখে, তাহলে সমস্যাটি সম্পূর্ণ বন্ধ করা সম্ভব। উৎপলবাবুর মত সমর্থন করেন ভারতীয় সেনা বাহিনীর সাবেক চিফ অফ স্টাফ জেনারেল শঙ্কর রায়চৌধুরী। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেছেন, ”সীমান্তে কোনো কোনো সময় সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে গুলি চালাতেই হয়। কারণ, অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটে। পাচারের ঘটনা ঘটে। তবে ফেলানীদের মৃত্যুর ঘটনা সব সময়ই দুঃখজনক। আমরা চাই না, এমন হোক। আলোচনার মাধ্যমেই এর সমাধানসূত্র খুঁজে বের করতে হবে।”
অনুপ্রবেশ, সীমান্ত হত্যা নিয়ে দীর্ঘদিন লড়াই করেছেন সাবেক সাংসদ এবং সর্বভারতীয় কৃষকসভার নেতা হান্নান মোল্লা। সিপিএমের এই বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ মনে করেন, ”দুই দেশের সরকার চাইলে সাত দিনের মধ্যে সীমান্ত হত্যা বন্ধ করতে পারে। সেই ক্ষমতা তাদের আছে। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। এর সঙ্গে দুই দেশের সীমান্তে বন্দুকধারী ও বন্দুক ছাড়া প্রচুর মানুষের স্বার্থ জড়িয়ে আছে।”
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন সাংবাদিক মিলন দত্ত। তাঁর মতে, ভারত-পাকিস্তান কিংবা ভারত-চীন সীমান্ত আর ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত এক নয়। এই সীমান্ত অনেক বেশি পোরাস। ফলে ভুটান বা নেপালের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত যেমন, বাংলাদেশের সঙ্গেও তেমনই হওয়া উচিত। সেই কথা মাথায় রেখেই এক সময় আসাম, মিজোরাম এবং ত্রিপুরায় সীমান্ত হাট শুরু হয়েছিল। দুই দেশের মানুষ সেখানে এসে জিনিসপত্র কেনাবেচা করতে পারতেন। বর্তমানে তা-ও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সীমান্তে কড়াকড়ি যত বাড়বে, হত্যা, অত্যাচারের ঘটনাও তত বাড়বে।
পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম সীমান্ত রয়েছে ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে। চার হাজারেরও কিছু বেশি অঞ্চল সীমান্তে রয়েছে। দুই দেশের মানুষের কাজ, সংস্কৃতি সব কিছুই জড়িয়ে রয়েছে এই সীমান্ত ঘিরে। সীমান্ত হত্যা সেই সংস্কৃতিকেই নষ্ট করে দিচ্ছে বলে অধিকাংশ মানবাধিকার কর্মীর অভিমত। সকলেরই বক্তব্য, দুই দেশের সরকার চাইলে এর সমাধানসূত্র খুঁজে বের করা খুব কঠিন হবে না।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।