বেলা ফুরাবার আগে সেতুর কাছকাছি সড়কে হেঁটে চলা ভিনদেশির গন্তব্য জানতে চাইলেন স্থানীয় একজন। আগন্তুকের জবাব, “আজ বগুড়া পর্যন্তই। নেপাল থেকে এসেছি, হেঁটে বাংলাদেশ দেখব।”
প্রশ্নকারী অবাক বিস্ময়ে বললেন, “এইভাবে!”
ভিনদেশি ওই তরুণের সঙ্গী ফ্রিল্যান্স ভ্রমণলেখক হোমায়েদ ইসহাক মুন বুধবার সন্ধ্যায় বগুড়ার শাহজাহানপুরের বেজোড়া সেতু এলাকা থেকে ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন। একপর্যায়ে তিনি নিজের মোবাইলেই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এর প্রতিবেদক শাহরিয়ার নোবেলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন ওই ভিনদেশির সঙ্গে।
জানা গেল, পরিব্রাজকের নাম দেবনাগরী লিপিতে ईः ईः (বাংলায় উচ্চরণ ঈঃ কিংবা ঈঅ)। পায়ে হেঁটেই নিজের দেশ চষে ফেলেছেন ২৭ বছর বয়সী এ নেপালি।
হেঁটে হেঁটে ঘুরেছেন ভারত, শ্রীলঙ্কার নানা এলাকা। এবার এসেছেন বাংলাদেশে। হাঁটছেন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত।
ईः বাংলাদেশে এসেছেন ২৫ দিন হল। পর্যটন নগরী কক্সবাজার, বন্দরনগরী চট্টগ্রাম আর রাজধানী ঢাকা ঘুরে তার পা এখন উত্তরে।
রোমাঞ্চকর এই ভ্রমণপিয়াসুকে ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে প্রশ্ন করতেই অবাক হতে হল। ছোটবেলা থেকে ছিলেন খুবই কৌতূহলী, চারপাশের নানা জিনিস নিয়ে বারবার প্রশ্ন করতেন। শিক্ষকদের কাছে ছুড়তেন হাজারো প্রশ্ন, কিন্তু পাঠ্যবই মোটেও ভালো লাগত না।
বাংলার পথ ধরে হাঁটিতেছে নেপালি তরুণ
সে সময় থেকেই ঘুরে ঘুরে দেশ-বিদেশ দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা, মানুষকে জানার আগ্রহ। সেই আগ্রহ ১৪ বছর বয়সে তাকে ঘর থেকে বের করে, স্কুলে আর ফেরেননি।
এই কৌতূহলীর সঙ্গে যতই আলাপ গড়াচ্ছিল, বিস্ময় ততোই বাড়ছিল। জানালেন, তিনি যখন প্রথম যাত্রা করেন, তখন তার ব্যাগের ওজন ছিল প্রায় ১৭ কেজি। তাতে থাকতো এনার্জিবার (শক্তিযোগান দেওয়া খাবার), একটা ছোট ঝুড়ি, কম্বল, দুই জোড়া প্যান্ট আরও বেশকিছু দরকারি জিনিস।
ईः যত হেঁটেছেন, ততই তিনি ওই বোঝা থেকে মুক্ত হয়েছেন। সময়ের সাথে সাথে ব্যাগের ওজন নামিয়েছেন এক কেজিতে। এখন তার ব্যাগে থাকে কেবল একটি পাওয়ার ব্যাংক, ঝান্ডু বাম, পাতলা রেইনকোট, মোমবাতি আর কাপড়। হাতে একটা মোবাইল, সেটা ছবি তোলার জন্য; গলায় ইয়ারফোন, পিঠে কাঁধব্যাগ।
এই তরুণ যখন নেপালের বিভিন্ন স্থান দেখা শুরু করেন, তখন প্রত্যেকবার কাঠমুণ্ডু থেকে নতুন জায়গায় যাওয়ার পরিকল্পনা করতে হত। তাতে এক ধরনের বিরক্তি আসে। তখনই একবারে পুরো দেশ ঘুরে দেখার কথা ভাবতে শুরু করেন।
সেই ভাবনা থেকে বেরিয়ে পড়েন ২০১৭ সালের মে মাসে। পরের বছরের এপ্রিলে তার নেপাল যাত্রা শেষ হয়।
বরফঢাকা হিমালয়ের উপত্যকা থেকে শুরু করে, সবুজ পাহাড় ডিঙিয়ে নেপাল দেখেন পায়ে হেঁটে। স্যান্ডেল পায়ে পুরো যাত্রায় তিনি ২২৫ দিন হেঁটেছেন। অতিক্রম করেছেন প্রায় ৬ হাজার কিলোমিটার পথ।
কিন্তু শরীরেও তো কুলাতে হবে। তাই থামতে হয় এরপর। দীর্ঘ হণ্টনে বাঁ পায়ের গোড়ালিতে ক্ষত হওয়ায় ছাড়তে হয় স্যান্ডেল। নিজেকে ঠিকঠাক করে আবারও শুরু করেন যাত্রা। স্যান্ডেল ছেড়ে কেডস পরে হাঁটতে শুরু করেন নতুন জায়গায়, ঘুরে দেখতে থাকেন নতুন নতুন জনপদ।
ईः বললেন, “ভারত আর শ্রীলঙ্কায় আরও প্রায় সাত হাজার কিলোমিটার হাঁটার পর এবার আমি বাংলাদেশে এসেছি। ২৫ দিন আগে বাংলাদেশে হাঁটা শুরু করি। গত ১৮ অগাস্ট থেকে আমি হাঁটছি।”
বিমানে বাংলাদেশে আসার পর প্রথমে গাড়িতে করে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে যান এই নেপালি তরুণ। সেখানে জিরো পয়েন্ট থেকে শুরু হয় তার বাংলাদেশ পর্বের হাঁটা।
“আমি কখনও বাধ্য না হলে গাড়ি-বিমানে চড়ি না। কিন্তু কিছু জায়গায় চড়তে হয়,” বললেন ईः।
বাংলাদেশে আসার প্রশ্ন উঠতেই জানালেন, বিশেষ কারণ নেই, কেবলই দু চোখ মেলে দেখার ইচ্ছা।
“আমি নেপালে হাঁটার পর ভারতের কার্গিলে গেছি। সেখান থেকে শ্রীলঙ্কার উত্তর থেকে দক্ষিণের কিছু শহর ঘুরেছি। আমি দক্ষিণ এশিয়ার পুরো চিত্রটা বুঝতে চাই।
“একটার পর একটা দেশ ঘুরে দেখার অংশ হিসেবে বাংলাদেশ এসেছি। বাংলাদেশে না এলে আমার এই চিত্রটা আমার কাছে কখনও স্পষ্ট হত না।”
হাঁটতে-হাঁটতে বাংলাদেশে কী দেখলেন? ईः জানালেন, দক্ষিণে যে জায়গা থেকে শুরু করেছিলেন, তার সঙ্গে উত্তরের জনপদের অনেক বৈপরীত্ব চোখে পড়েছে।
“চট্টগ্রামে বন্দরের ব্যস্ততা দেখেছি, সেখানে সমুদ্র, অনেক কর্মব্যস্ত মানুষ। আবার ঢাকার কাছাকাছি এসে দেখেছি অনেক শিল্প কারখানা। এখন টাঙ্গাইল পার হয়ে বগুড়ার দিকে আছি। এখানে অনেক সবুজ গাছপালা, গ্রাম, ফসলের মাঠ। এটা খুব ভালো দিক। আমি অনেক ধরনের সৌন্দর্যের দেখা পেয়েছি।”
বাংলাদেশের মানুষে আতিথেয়তায় মুগ্ধতাও প্রকাশ পেল তার বয়ানে।
“আমি যেখানেই গেছি, সেখানেই বন্ধুবৎসল মানুষ পেয়েছি। সবচেয়ে বেশি সহায়তা আমি পেয়েছি, যারা গরিব এবং কর্মজীবী- মানুষ তাদের কাছ থেকে। ঢাকার উত্তরে এক জায়গায় আমি কোনো থাকার জায়গা পাচ্ছিলাম না। এক টং দোকানি আমাকে তার দোকানের বেঞ্চে সারারাত থাকার জায়গা দিয়েছেন।”
এত অল্প জিনিস নিয়ে কীভাবে দীর্ঘ সময় পথে পথে চলা যায়? উত্তরে তিনি বললেন, “এত অল্প জিনিস নিয়ে ঘোরার পেছনে কোনো রহস্য নেই। আমি হাঁটতে বেরিয়েছি, ঘুরতে নয়।
“আমার কখনও পাহাড় পার হতে হয়, কখনও নদী। কখনও রোদে হাঁটি, কখনো বৃষ্টিতে; তাই এত জিনিস নিয়ে আমি কি করব?”
পায়ে হেঁটে পৃথিবী জয়ের স্বপ্ন দেখা এই মানুষটি জানালেন, ভ্রমণই তাকে নতুন নতুন দরজা খুলে দিচ্ছে। যেদিন থেকে বেরিয়ে পড়েছিলেন, সেদিন থেকে কোনো না কোনো ঢেউ থাকে নিয়েছে সামনের দিকে।
“খুব ছোটবেলা থেকেই আমি নেপালে সামাজিক নানা সংগঠনের সাথে কাজ করতাম। সেখান থেকে ঘোরা শুরু। একসময় আমি কোনো প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করার কোনো অর্থ আর খুঁজে পাইনি। নেপালে যখন হাঁটা শুরু করি, যোগাযোগ তৈরি হয়, পরিচিতি বাড়ে।
“নেপাল ঘোরা শেষ হওয়ার পর যখন আমি দক্ষিণ এশিয়া ঘুরে দেখার চিন্তা করলাম, তখন আমি জানতাম আমার অর্থ লাগবে। আমার ভ্রমণের যত জার্নাল, ছবি আমার কাছে ছিল, সেগুলো একটা বই হিসেবে প্রকাশ করি, সেখান থেকে কিছু টাকা পাই। আর এমন সাদামাটা ঘুরলে কত টাকাই বা লাগে!”
বাংলাদেশে এসে তেমন কোনো সমস্যায় পড়েননি বলে জানালেন ईः। বললেন, “ভাষা আমার কাছে কিছুটা সমস্যা ছিল। কিন্তু রাস্তায় চলতে চলতে দরকারি কিছু বাংলা আমি শিখে নিয়েছি। আর মানিয়ে নিতে পারলে কোনো সমস্যাই হয় না।
“আমাদের ওখানে যেমন ডালভাত, তেমন বাংলাদেশেও ডালভাত, সবজি পাওয়া যায়- কোনো সমস্যা হয় না।”
তবে বাংলাদেশ নিয়ে হতাশাও আছে এই নেপালির। এদেশের বর্জ্য অব্যবস্থাপনা, নদী দূষণ তার ভালো লাগেনি।
“বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার গত দশকের এক তারা। এখানে নজরুল, রবীন্দ্রনাথের জন্ম। এখানকার পরিবেশ আরও ভাল হতে হবে। মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাও বাড়াতে হবে।”
টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থেকে বগুড়া পর্যন্ত তার হাঁটার সঙ্গী ছিলেন ভ্রমণলেখক হোমায়েদ ইসহাক মুন। তিনি বললেন, “হাঁটা আর জনপদ দেখা- একটা অন্যরকম চিন্তাধারা। সবাই এভাবে পারে না। এটা একটা দর্শন। যার এই দর্শন আছে, সে পারে।”
হাঁটার মাধ্যমে ईः কী বার্তা দিতে চান? তিনি বললেন, “আমি এমন উদ্দেশ্যে বেরিয়েছি, যেখানে আমি অনেক মানুষের সাথে মিশব, কথা বলব, তাদের জানব। আমি নানা মানুষের সাথে মিশছি, আমি এভাবে ঘুরে যা জানতে পারছি তা আমি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জানতে পারতাম না।
“আমার কাছে হাঁটাটাই একটা বার্তা। আমার এই বেরিয়ে পড়াটাই একটা বার্তা।” সূত্র : বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।