আশরাফুল হক : সিভিল এভিয়েশন অথরিটি বিমানবন্দর উন্নয়ন ফি ও নিরাপত্তা ফি আরোপ করায় প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকদের অভিবাসন খরচ বেড়ে যাবে। আগামী রবিবার থেকে এ ফি কার্যকর হচ্ছে। সিভিল এভিয়েশনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সও চাইছে গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং চার্জ বাড়াতে। নিয়ন্ত্রক ও বাণিজ্যিক উভয় সংস্থার আয় বাড়ানোর এ কৌশল এমন এক সময় কার্যকর করা হচ্ছে যখন সারা বিশ্বের এয়ারলাইন্সগুলো কোভিড-১৯-এর জন্য অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে।
সিভিল এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, ‘এসব চার্জ এবং ফি বাড়ালে শুধু অভিবাসন খরচই বাড়বে না এর প্রভাব পড়বে শিক্ষার্থীদের ওপরও। বাদ যাবেন না তীর্থযাত্রী এমনকি ভ্রমণকারীরাও। যারা চিকিৎসার জন্য যাচ্ছেন তাদের ওপরও বিরূপ প্রভাব পড়বে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এয়ারপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফি এবং সিকিউরিটি ফি রয়েছে। বাংলাদেশও এসব ফি আরোপ করতে পারে। কিন্তু যখন এয়ারলাইন্সগুলোর মুমূর্ষু অবস্থা তখন কেন এসব চার্জ আরোপ করতে হবে? করোনাভাইরাসের মধ্যে এখন সময় সবাইকে নিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাওয়া। এখন ফি আরোপের সময় না।’
সরকার সার্কভুক্ত দেশের ক্ষেত্রে যাত্রীপ্রতি ৫ ডলার বিমানবন্দর উন্নয়ন ফি ও ৬ ডলার যাত্রী নিরাপত্তা ফি আরোপ করেছে। সার্কভুক্ত দেশগুলো ছাড়া অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে বিমানবন্দর উন্নয়ন ফি ১০ ডলার এবং নিরাপত্তা ফি ১০ ডলার। অভ্যন্তরীণ যাত্রীদের ক্ষেত্রে ১০০ টাকা বিমানবন্দর উন্নয়ন ফি ও ৭০ টাকা যাত্রী নিরাপত্তা ফি আরোপ করা হয়েছে। এ ফি গত ২৭ ফেব্রুয়ারি অর্থ মন্ত্রণালয় অনুমোদন করেছে। আর বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এ ফি কার্যকরের বিষয়টিতে অনাপত্তি দেয় গত ১৩ জুলাই।
সিভিল এভিয়েশন অথরিটির চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান গতকাল বলেন, ‘আগামী রবিবার থেকে বিমানবন্দর উন্নয়ন ফি ও নিরাপত্তা ফি কার্যকর করা হবে। বিমানবন্দরগুলোর যাত্রী নিরাপত্তা, সেবার মানবৃদ্ধি এবং বিমানবন্দরগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়নের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের বিমানবন্দরসমূহ ব্যবহারকারী সকল বহির্গামী যাত্রীদের নিকট থেকে যাত্রী নিরাপত্তা ফি এবং বিমানবন্দর উন্নয়ন ফি আরোপ করা হচ্ছে।’
গত তিন বছর ধরে বিমানবন্দর উন্নয়ন ফি ও নিরাপত্তা ফি আরোপ করার চেষ্টা করছে সরকার। দুই বছর আগে এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব সিভিল এভিয়েশন থেকে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলেও ফি নির্ধারণ নিয়ে সময় নেয় সরকার। এ সময় নানা ধরনের বৈঠক করে ফি আরোপ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে তা অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হয়। এ সংক্রান্ত প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ে গেলে তারা ফির পরিমাণ আরও বেশি ধার্য করার কথা বলে। এ নিয়ে সমঝোতা করতেও অনেক দিন পার হয়ে গেছে।
সিভিল এভিয়েশন অথরিটি যখন সরকারের কাছ থেকে বিমানবন্দর উন্নয়ন ফি ও নিরাপত্তা ফি আরোপ করার ‘সবুজ সংকেত’ পায় বিমান তখন গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং ফি বাড়ানোর বায়না ধরে। বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং সেবা নিয়ে অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থারই আপত্তি রয়েছে। এই অবস্থায় গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং চার্জ বাড়ানোর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের কাজ বিমানের না হলেও বিমান গায়ের জোরে তা করে যাচ্ছে। পৃথিবীর সব দেশেই বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজ এয়ারপোর্টে নেমে এলে গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং সেবা দেয় সিভিল এভিয়েশন অথরিটি। কিন্তু বিমান শুরু থেকেই এখানে আধিপত্য বিস্তার করে চলছে। নিজেদের কাজ না হওয়ার পরও গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং করেই বিমান মূলত টিকে আছে। এ খাতে বিমানের বছরে অন্তত ৩০০ কোটি টাকা আয় হয়।
বিমানের এক কর্মকর্তা জানান, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব এবং বিশ্বব্যাপী এর বিস্তারে বিমানের ব্যবসায়িক কার্যক্রম সংকুচিত হয়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি মোকাবিলায় গত ১৯ এপ্রিল বিমানের নির্বাহী পরিচালকমণ্ডলীর সভায় বিভিন্ন ধরনের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং চার্জ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। চার্জ বাড়ানোর বিষয়টি অবহিত করার জন্য বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলে তারা অন্যান্য দেশের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং চার্জ সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য জানতে চায়। মন্ত্রণালয়ের এ চিঠি পেয়ে বিমান বিভিন্ন এয়ারপোর্টের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের দর সংগ্রহ করে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। দর বৃদ্ধির বিষয়টি এখন মন্ত্রণালয়ের বিবেচনায় রয়েছে বলে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে সিভিল এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, ‘এখন বেশিরভাগ এয়ারলাইন্স বন্ধ রয়েছে। ফ্লাইট চালাতে পারছে না। এ কারণে এয়ারলাইন্সগুলোর ভাড়াও অনেক বেড়ে গেছে। এই অবস্থায় উন্নয়ন ফি ও নিরাপত্তা ফি আরোপ অন্য সময় করা যেত। এসব ফি বাড়ানোর জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থা আইএটিএর পক্ষ থেকেও প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। এসব ফি প্রত্যাহারের জন্য তারা দাবি জানিয়েছে। আমাদের সিভিল এভিয়েশন নিয়ম করেছে একটি ফ্লাইটে ৭০ শতাংশের বেশি যাত্রী নেওয়া যাবে না। ৩০ শতাংশ সিট খালি রাখতে হচ্ছে। এর ফলে তারা টিকিটের দাম বাড়িয়েছে। এক দিকে করোনার কারণে প্লেনের ভাড়া বেড়ে গেছে তার ওপর এসব ফি বৃদ্ধি যোগ হচ্ছে। করোনায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। এই অবস্থায় এসব ফি আরোপ বিপর্যয় ডেকে আনবে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশ বিমানবন্দরের খরচ কমিয়ে দিচ্ছে। সিঙ্গাপুর বলছে, তোমরা আমাদের দেশে ব্যবসা করতে আস। তোমাদের অফিস ভাড়া দিতে হবে না। পার্কিং চার্জ ৫০ শতাংশ কমানো হবে। এখন অল্প প্লেন চলছে। এখন সিভিল এভিয়েশনের উচিত বেশি সংখ্যক এয়ারক্রাফট আসার সুযোগ সৃষ্টি করা।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যেন সচল থাকে সেজন্য এখন নতুন কোনো ফি আরোপের সময় না এটা। এই সময় বিমানকে কেন গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং চার্জ বাড়াতে হবে? বিমানতো এখন এয়ারক্রাফট চালায় না। এয়ারক্রাফটগুলো বসিয়ে রেখেছে। তাদের অন্য দিকে যত লোকসান তা তারা গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং দিয়ে পুষিয়ে নিচ্ছে। গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ে আর কাউকে সুযোগ দেওয়া হয় না। বিমান একা মনোপলি ব্যবসা করছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় বর্তমানে ঢাকার গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং চার্জ অনেক বেশি। বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং চার্জ নিয়ে বিভিন্ন মহলের অসন্তোষ রয়েছে। এত কিছুর পরও বিমান তাদের কোয়ালিটি বাড়াচ্ছে না। এটা ঠিক না।’ সূত্র : দেশ রূপান্তর
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।