জুমবাংলা ডেস্ক : রিজেন্ট গ্রুপ ও রিজেন্ট হাসপাতাল লিমিটেডের চেয়ারম্যান ‘সিলেটি জামাই’ সাহেদ করিম ওরফে মো. সাহেদের প্রতারণার বিশাল একটি অংশজুড়ে ছিলো সিলেট। বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে নানা শ্রেণির ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে সাহেদ পাততো প্রতারণার অভিনব ফাঁদ। এতে ফেঁসে সিলেটের অনেকেই হারিয়েছেন নিজের সর্বস্বটুকু, আবার কেউ নিজের বুদ্ধিমত্তায় বেরিয়ে এসেছেন তার জালিয়াতির জাল ছিন্ন করে।
সাহেদ গ্রেফতারের পর একে একে বেরিয়ে আসছে তার সিলেটকেন্দ্রীক ভয়ানক প্রতারণার গল্পগুলো। ১০ বছর আগে সাহেদের এমনই এক ভয়ঙ্কর ফাঁদ থেকে কোনোমতে বেঁচে যান সিলেটের এক প্রেস ব্যবসায়ী। তিনি শনিবার এ প্রতিবেদকের মোবাইল ফোনে কল দিয়ে সেদিনের সেই প্রতারণার গল্পটি জানান এবং নিজের ফেসবুক আইডিতে সেটি তুলে ধরেন। মঈন উদ্দিন নামের এই প্রেস ব্যবসায়ীর প্রতিষ্ঠান সিলেট নগরীরর জিন্দাবাজারস্থ রাজা ম্যানশনে। তার বক্তব্যটি হুবহু তুলে ধরা হলো:
‘‘স্মৃতির পাতা ঘেঁটে বছর দশেক পূর্বের ঘটনাটি মনে পড়ে গেলো। একটি লোগো বসিয়ে কলাম দিয়ে একটি পেজের কাজ নিয়ে এক দুপুরে জিন্দাবাজারে আমাদের প্রতিষ্ঠানে ননসিলেটী এক ভদ্রলোক আসেন। কথাবার্তায় তাঁকে উচ্চশিক্ষিত মনে হলো। তখনকার আমার গ্রাফিক্স ডিজাইনার অতি অল্প সময়ে চাহিদামাফিক কাজ করে প্রিন্ট দিয়ে দিতেন।
আমার দোকানে আসা সেই ভদ্রলোক সেদিন জানান, কোম্পানির কাজে তিনি সিলেট এসেছেন। কাজ শেষে তিনি একশ টাকার একটি চকচকে নোট দিয়ে দেন। যা ছিলো আমাদের চাহিদা থেকে একটু বেশিই। আমরা তাকে চা পান করালাম। চা পানের সময় তিনি চাররঙা ইংরেজি একটি ম্যাগাজিন বের করে এমন একটি ম্যাগাজিন ছাপার হিসাব-নিকাশ জানতে চান। অতঃপর ম্যাগাজিন ছাপার ব্যাপারে চূড়ান্ত আলাপের লক্ষ্যে আমাকে স্বশরীরে ঢাকার উত্তরায় অবস্থিত তাদের অফিসে যেতে প্রস্তাব করেন। তিনি আমার একটি ভিজিটিং কার্ড নিয়ে ওইদিনের মতো চলে যান।
পরদিন ঢাকা থেকে ওই ব্যক্তি ফোন করেন। তিনি জানান, ‘বস’র (সাহেদ) সঙ্গে আমাদের দোকানের সার্ভিস নিয়ে কথা বলেছেন। ‘বস’ আমার প্রেসের কাজে অত্যন্ত সন্তুষ্ট। তিনি আমাকে তার ঢাকা উত্তরার অফিসে চা পানের দাওয়াত করেছেন।
দু’দিন পর আমি ট্রেনযোগে ঢাকা বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছে ভদ্রলোককে কল করি। তিনি সাথে সাথে স্টেশনে এসে আমাকে রিসিভ করে তাদের অফিসে নিয়ে যান। ভদ্রলোক অফিসের একটু দূরে থাকতেই বসকে (সাহেদ) কল করেন। একটু পরেই ওই বসরূপী সাহেদ আমাকে রিসিভ করতে বের হন।
অফিসকক্ষে নিয়ে অতি সম্মানের সঙ্গে সাহেদ আমাকে বসতে দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন বলেন, অফিসের সবার ছুটি হয়ে গেছে। আগামীকাল সকালে আমার সাথে ম্যাগাজিন নিয়ে অফিসের চুক্তি হবে। চা পানের পর আমি তার কাছে ঐ দিনের জন্য বিদায় চেয়ে উঠে পড়ি।
পরদিন সকালে আমি সাহেদের উত্তরার অফিসে যাই। সাহেদ আমার জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করেন। এক সাথে দু’জন বসে নাস্তা করি। নাস্তা সার্ভ করেন একজন সুন্দরী তরুণী, মেয়েটিকে মনে হচ্ছিলো চিত্রজগতের নায়িকা। নাস্তার ফাঁকে সাহেদ বলে উঠেন, ম্যাগাজিনের কাজটার বিল পরিশোধ করবেন দুই বিদেশি ডোনার। কাজের বিলের সাড়ে তিন লাখের সাথে আরো ৫০ হাজার টাকা যুক্ত করে চার লাখ টাকার বিল বানানোর প্রস্তব দেন সাহেদ। তিনি বলেন, ৫০ হাজার টাকা আমার (সাহেদের) কমিশন। বিদেশি দু’জন ডোনার আসবে। ম্যাগাজিন সম্পর্কে তাদের সাথে আমাকে কথা বলে চুক্তি ফাইনাল করতে হবে। ডোনারের একজন বোম্বের অধিবাসী, অন্যজন কুয়ালালামপুরের বলে জানান সাহেদ।
২০০৪ সনে আমি কুয়ালালামপুর সফর করেছিলাম। লম্বা আকৃতি এবং চেহারা দেখে চুক্তির জন্য আসা লোকটিকে মালয়েশিয়ান বলে মনে হলো না আমার। মালয়েশিয়ান মানুষ সাধারণত: এত লম্বা হয় না। আর তাদের মুখের গঠন আমাদের সিলেটি মণিপুরীদের মতো। আমার মনে ওই সময় সন্দেহ জাগ্রত হওয়ায় লোকটিকে কুয়ালালামপুর সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করে কোনো সদুত্তর পাইনি। অবশ্য বোম্বের লোকটির সাথে হিন্দিতে কথা বলে মোটামোটি সন্তোষজনক জবাব পাই।
পরে সবার জন্য দুপুরের খাবার আসে। একটু টক স্বাদের পোড়া গোশতসহ বড়লোকের সব আইটেম, যা আরবি শেখেরা খেয়ে থাকে। সবাই মিলে দুপুরের খাবার খাওয়ার পর ম্যাগাজিন নিয়ে এ-ফোর সাইজের একটি সাদা কাগজে চুক্তিপত্র হয়। চুক্তির মূল কপি আমার কাছে এবং ফটোকপি তাদের অফিসে রাখা হয়।
সাহেদ পরবর্তীতে আমাকে অনুরোধ করলেন, তিনদিন পর ক্যাশ পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে তার অফিসে যেতে। ঐ দিন তিনি কোম্পানির এক লাখ টাকার চেকের সাথে ছাপার অর্ডারটি আমাকে বুঝিয়ে দেবেন।
সেদিন বিকাল ৩টায় সিলেটগামী ট্রেনে আমাকে উঠিয়ে দেয়া হয়। ট্রেনে বসে দু’দিনের ঘটনার আদ্যোপান্ত বিশ্লেষণ করে ঢাকা ট্যুরকে লস প্রজেক্ট মনে করে সব কিছু মন থেকে মুছে ফেললাম। তিন দিন পর আমার মোবাইলে বেশ কয়েকটি কল আসলেও আমি এই কাজটি করতে আগ্রহী নই বলে সাফ জানিয়ে দেই।
আজ ২০২০ সালে এসে সিলেটি এক পাথর ব্যবসায়ীর সঙ্গে সাহেদের ৩০ লক্ষ টাকার প্রতারণার ঘটনাটি জেনে নিজেকে ভাগ্যবানই মনে হচ্ছে।
উল্লেখ্য, করোনাভাইরাস পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট প্রদান ও অর্থ আত্মসাৎসহ প্রতারণার অভিযোগে রিজেন্ট গ্রুপ ও রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান সাহেদ করিম গ্রেফতারের পর আদালতের নির্দেশে রিমান্ডে রয়েছেন। রিজেন্টে অভিযানের পর থেকেই তার বিষয়ে বহু প্রতারণার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।