জুমবাংলা ডেস্ক : মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী উপজেলায় এক বৌদ্ধ রাজার বসবাস ছিল। সেই চন্দ্র বংশীয় বৌদ্ধ রাজা শ্রীচন্দ্র খ্রিস্টীয় দশম শতকের প্রথম দিকে আনুমানিক ৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান জুড়ী উপজেলার সাগরনাল গ্রামে ‘চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও প্রাচীন এ বিশ্ববিদ্যালয়। নানা বিষয় পড়ানো হতো সেখানে।
কালের বির্বতনে এটি হারিয়ে গেলেও সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে জনমনে সৃষ্টি হয়ছে নতুন আগ্রহ আর আলোচনার। বিষয়টি জানতে পেরে নড়েচড়ে বসেছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। এ বিষয়ে সরেজমিন পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দিতে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর সিলেটের দায়িত্বপ্রাপ্ত আঞ্চলিক পরিচালককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. হান্নান মিয়া (অতিরিক্ত সচিব) জানান, মন্ত্রী বিষয়টি আমাকে জানানোর পর আমি খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি। আমি আমার আঞ্চলিক পরিচালককে বিষয়টি সরেজমিন তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে বলেছি। প্রাথমিক তদন্তে কিছু পেলে আমরা পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব। আমরা যদি এটা উন্মোচন করতে পারি তবে বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসে বড় মাইলফলক হয়ে থাকবে।
তিনি বলেন, আমার কাছে তথ্য আছে রাজা শ্রীচন্দ বিক্রমপুর এলাকায় ছিলেন। সেখানে তার শ্রীহট্ট মন্ডল ছিল। সেখান থেকে তিনি বহিরাগতদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন আর যুদ্ধ যেহেতু করেছিলেন নিশ্চয় সেখানে স্থাপনা রয়েছে। স্থাপনা থাকার সম্ভাবনা বেশি। সিলেটের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক ড. আতাউর রহমান বলেন, তথ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের নির্দেশ মতে শনিবার সরেজমিন তদন্ত সাপেক্ষে প্রতিবেদন জমা দেব।
তিনি বেলেন, ভারতবর্ষে তাম্রশাসনের ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রাচীনকালে তাম্রশাসন ছিল তামার পাতে লিখিত দলিল। রাজা-বাদশারা বিভিন্ন রাজকীয় নির্দেশ তামার পাতে খোদাই করে রাখতেন। চন্দ্রবংশীয় বৌদ্ধ রাজা শ্রীচন্দ্র এই তাম্রশাসন প্রদান করেছিলেন। চন্দ্র রাজবংশের রাজাদের মধ্যে শ্রী চন্দ্র ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ রাজা। ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদারের ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’ গ্রন্থ মতে- শ্রী চন্দ্রের শাসনামল ছিল ৯০৫-৯৫৫ সাল পর্যন্ত। তার সাম্রাজ্যেভুক্ত এলাকার মধ্যে ছিল মানিকগঞ্জ, ঢাকা ফরিদপুরের পদ্মা তীরবর্তী এলাকা, শ্রীহট্ট অঞল ও কুমিল্লা। যার রাজধানী ছিল বিক্রমপুর। মৌলভীবাজার জেলায় ১৯৬১ সালে একটি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হয়। যার তথ্য মতে আনুমানিক ৯৩৫ খ্রী. শ্রীহট্টে সম্পূর্ণ রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন রাজা শ্রীচন্দ্র।
তিনি জানান, প্রত্নতত্ত্ববিদ কমলাকান্ত গুপ্ত চৌধুরী তাম্রশাসন সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। লেখক ও ব্যাংকার অমিতাভ পাল চৌধুরী তার এক প্রবন্ধে সুজিত চৌধুরীর ‘শ্রীহট্ট কাছাড়ের প্রাচীন ইতিহাস, নীহার রঞ্জন রায়ের ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস (আদিপর্ব), মো. জহিরুল হক ও বায়োজিত আলমের ‘প্রাচীন সিলেটের চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয় : একটি ইতিহাসভিত্তিক পর্যালোচনা’ শিরোনামের গবেষণা প্রবন্ধের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, শ্রীচন্দ্রের সাম্রাজ্য অনুসারে এ অঞ্চলে একটি বিশ্ববিদ্যালয় থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মৌলভীবাজার জেলায় আবিষ্কৃত তাম্রশাসন অনুযায়ী খ্রিস্টীয় দশ শতকের প্রথম ভাগে উত্তরে কুশিয়ারা নদী, দক্ষিণ ও পশ্চিমে মনু নদী এবং পূর্বে ইন্দেশরের পাহাড়ি অঞ্চল বা পাথরিয়া অঞ্চল এই সীমানার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল।
তিনি বলেন, সেই হিসেবে মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী উপজেলার সাগরনাল ইউনিয়নের দীঘিপাড় এলাকাকে ইঙ্গিত করা। কারণ এখানে এককালে বিশ্ববিদ্যালয় ছিল এই জনশ্রুতির পাশাপাশি এ এলাকায় মাটির নিচে এখনও প্রাচীনকালের তৈরী বড় বড় ইট পাওয়া যায়।
উইকিপিডিয়া সূত্রে জানা যায়, চন্দ্র রাজবংশ দশম ও একাদশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষে শাসন করা এক বৌদ্ধ ধর্মালম্বী রাজবংশ ছিল। ভারতীয় উপমহাদেশের এই রাজবংশ মূলত বাংলার সমতট অঞ্চল ও উত্তর আরাকান শাসন করত। চন্দ্র রাজবংশের শাসনকাল দশম ও একাদশ শতাব্দীর মধ্যে ছিল। চন্দ্র রাজবংশের পাঁচজন উল্লেখযোগ্য রাজার মধ্যে শ্রীচন্দ্র ছিলেন চন্দ্র রাজবংশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজা। তিনি দীর্ঘ ৪৫ বছর শৌর্য-বীর্য ও সাফল্যের সঙ্গে রাজত্ব করেন। সমগ্র বঙ্গ এবং উত্তর-পূর্বে কামরূপ পর্যন্ত চন্দ্রদের ক্ষমতা সম্প্রসারণের কৃতিত্ব শুধুই শ্রীচন্দ্রের। মৌলভীবাজার জেলার পশ্চিমভাগে প্রাপ্ত একটি তাম্রশাসনে কামরূপ অভিযান সম্পর্কে তথ্য রয়েছে।
একই তাম্রশাসনে তার উদ্যোগে সিলেট এলাকায় বিপুলসংখ্যক ব্রাহ্মণের বসতি স্থাপনের কথা জানা যায়। তিনি গৌড়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। দ্বিতীয় গোপালের শাসনকালে পালদের ক্ষমতা রক্ষাকল্পে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ভূমিদান সম্পর্কিত তার ৬টি তাম্রশাসন এবং তার উত্তরাধিকারীদের তাম্রশাসনে শ্রীচন্দ্র সম্পর্কে যে তথ্য পাওয়া যায় তা থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে বঙ্গ ও সমতটের বিস্তৃর্ণ এলাকায় তার শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল।
জানা যায়, রাজা শ্রীচন্দ্রের পশ্চিমবঙ্গ তাম্রশাসন বা সিলেট তাম্রশাসনটিও (৯২৫-৯৭৫ খ্রিস্টাব্দ) বাংলায় কম্বোজ শাসকদের শাসনকালে জারিকৃত একটি লিখিত দলিল। চন্দ্রবংশীয় রাজা শ্রী চন্দ্র (৯২৫-৯৭৫ খ্রি.) এই তাম্রশাসনটি জারি করেন। এতে সমতট দেশের খিরোদা নদীর তীরবর্তী অঞ্চল দেবপর্বত এর নাম উৎকীর্ণ এবং রাজা শ্রীচন্দ্রের পিতা রাজা তৈলক্যচন্দ্র কর্তৃক (৯০৫-৯২৫ খ্রি.) কম্বোজদের পরাজিত করার তথ্য বিধৃত। তাম্রলিপিটি পাঠোদ্ধার করে তাকে ইংরেজিতে ভাষান্তর করেছেন আহমেদ হাসান দানী।
প্রত্নতত্ত্ববিদরা বলেন, সম্পূর্ণ লিপিটি থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান যে, লালমাই বনাঞ্চল হতে কম্বোজদের সৈন্য সমতট অঞ্চলে আক্রমণ করেছিল এবং চন্দ্র বংশীয় রাজা ত্রৈলক্যচন্দ্র তাদের পরাজিত করে লালাম্বী রক্ষা করেছিলেন। প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজের মাধ্যমে চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনাবিষ্কৃত ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া গেলে তা বাংলাদেশ তথা বিশ্বের মধ্যে ইতিহাস হয়ে থাকবে। সূত্র : দেশ রূপান্তর
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।