জুমবাংলা ডেস্ক : কখনো মুখোমুখি সংঘর্ষ, কখনও লাইনচ্যুত হয়ে বা অন্য যানবাহনের সঙ্গে সংঘর্ষে দেশে বেশকিছু প্রাণঘাতি ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রাণ হারিরেছেন অনেক মানুষ। আবার গুরুতর আহত হয়ে অনেকে আজীবন পঙ্গুত্ববরণ করেছেন।
সোমবার কিশোরগঞ্জের ভৈরবে বড় ধরনের ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটনা ঘটেছে। এতে এখন পর্যন্ত ২৩ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে; আর আহত হয়েছেন শতাধিক মানুষ। দুটি ট্রেনের সংঘর্ষের ঘটনায় উদ্ধার অভিযান চালাচ্ছেন ফায়ার সার্ভিসসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে যে ধীর গতিতে ট্রেন চলাচল করে সেখানে লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটার জন্য রক্ষণাবেক্ষণের অভাবই দায়ী। আর অপারেশনের ঘাটতির কারণে একই লাইনে দুটো ট্রেন চলে আসতেও দেখা যাচ্ছে। যেখানে চালক ও সিগন্যালের দায়িত্বে যারা থাকেন তাদের ভুল রয়েছে।
২০২০ এবং ২০২১ সালে দেশে করোনার প্রকোপ থাকায় বিভিন্ন সময় ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। এ কারণে রেলপথে বিগত বছরগুলোর তুলনায় দুর্ঘটনা ও হতাহত কম ছিল। বিভিন্ন দুর্ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বেশিভাগ রেল দুর্ঘটনার মধ্যে মুখোমুখি ট্রেনের সংঘর্ষ ছাড়াও রেলক্রসিংয়ে অন্যান্য যানবাহনের সঙ্গে সংঘর্ষ, ধাক্কা এবং রেল লাইনে কাটা পড়ে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে।
সামগ্রিকভাব রেলপথ গভীর সংকটে আছে বলে মনে করেন যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘এই ধরনের ঘটনা আরও বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে জরুরি মেরামত বাদ দিয়ে নতুন রেলপথ তৈরিতে আমরা ব্যস্ত হয়ে আছি। যেখানে লাখো কোটি টাকার প্রকল্প হচ্ছে। কিন্তু যে সমস্ত জরুরি মেরামত প্রয়োজন, যেখানে অল্প টাকা বিনিয়োগ করে রেল পথ ঝুঁকিমুক্ত করা যায় সেটা করা হচ্ছে না।’
চলতি বছরের ১৬ এপ্রিল কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলার হাসানপুর রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মালবাহী ট্রেনকে পেছন থেকে ধাক্কা দেয় চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা যাত্রীবাহী ‘সোনার বাংলা এক্সপ্রেস’ ট্রেন। সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ট্রেনটি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় যাওয়ার পথে এই দুর্ঘটনায় পড়ে। মালবাহী ট্রেনের ধাক্কায় ৫ বগি লাইনচ্যুত ও অন্তত ৫০ জন আহত হন।
এই দুর্ঘটনার পর চট্টগ্রামের সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। স্টেশনে ট্রেন দুর্ঘটনায় ট্রেনচালক জসিম উদ্দিন, সহকারী চালক মহসিনের গাফিলতির প্রমাণ পায় তদন্ত কমিটি। এই ঘটনায় তারা ছাড়াও চট্টগ্রাম ডিভিশনের সোনার বাংলা আন্তঃনগর এক্সপ্রেস ট্রেনের পরিচালক ও হাসানপুর স্টেশনের মেইনটেইনার (সিগন্যাল) ওয়াহিদকে দায়ী করা হয়।
সীতাকুণ্ডের বড়তকিয়ায় মাইক্রোতে থাকা ১১ শিক্ষার্থীর মৃত্যু : ২০২২ সালের ২৮ জুলাই চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া ঝরনা দেখে মাইক্রোবাসে ফেরার পথে বড়তকিয়া এলাকায় ট্রেনের ধাক্কায় ১১ শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেদিন সেখানে গেটম্যান উপস্থিত ছিলেন না। গেটবার না ফেলায় মাইক্রোটি দ্রুত রেললাইন পার হচ্ছিল।
তাছাড়া ২০১৯ সালের জুন ও নভেম্বরে পৃথক দুটি রেল দুর্ঘটনা ঘটে। এতে অনেকে হতাহত হন এবং ক্ষয়-ক্ষতি হয়। তাছাড়া রংপুরের কাউনিয়া জংশনে উত্তরবঙ্গ মেইল লোকোমোটিভ পরিবর্তনের সময় কোচে গিয়ে সজোরে ধাক্কা লাগে। এতে ঘটনাস্থলেই ১ জন মারা যান। আর অন্তত ৪০ জন আহত হন। আর ২০২০ সালের ২১ ডিসেম্বর জয়পুরহাটে ট্রেনের সঙ্গে বাসের সংঘর্ষ হয়। এতে বাসের ১২ যাত্রী নিহত হন। এ দুর্ঘটনায় আহত হন তিনজন। হতাহতরা সবাই বাসের যাত্রী।
কুলাউড়া দুর্ঘটনা : ২০১৯ সালের ২৩ জুন রাত সাড়ে এগারোটার দিকে সিলেট থেকে ঢাকাগামী উপবন এক্সপ্রেস একটি কালভার্ট পার হওয়ার সময় দুর্ঘটনায় পড়ে। এই দুর্ঘটনায় পাঁচজন নিহত ও শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। তখন জানা যায়, কুলাউড়া স্টেশন পার হওয়ার পর হঠাৎ উপবন এক্সপ্রেস চালক ট্রেনের গতি বাড়িয়ে দেন। বড়ছড়া খালের ওপরে থাকা কালভার্টটি অতিক্রম করার আগে পেছনে থাকা ১০টি বগি সামনের ৭টি বগি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এসময় কালভার্টের ওপর থেকে একটি বগি ছিটকে বড়ছড়া খালে পড়ে যায়। বাকি বগিগুলোর দুটি উল্টে পাশের জমিতে পড়ে যায় ও বাকি সাতটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে রেললাইনের পাশে পড়ে। এ দুর্ঘটনায় রেলওয়ের যান্ত্রিক, সিগন্যাল ও টেলিকম, প্রকৌশল বিভাগ সব মিলিয়ে ২৮ কোটি ৩৪ লক্ষ টাকার ক্ষতি হয়।
কসবার মন্দবাগ দুর্ঘটনা : ২০১৯ সালের ১২ নভেম্বর রাত পৌনে তিনটার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার মন্দবাগে মুখোমুখি দুটি ট্রেনের সংঘর্ষ হয়। ঢাকাগামী আন্তঃনগর ট্রেন তূর্ণা নিশীথা এক্সপ্রেস ও চট্টগ্রামগামী আন্তঃনগর উদয়ন এক্সপ্রেসের মুখোমুখি সংঘর্ষে ১৭ জন নিহত হন। আর ৫৭ জন আহত হন। আর উদয়ন এক্সপ্রেসের তিনটি বগি দুমড়ে মুচড়ে যায়। হতাহতের বেশিরভাগ লোক এই ট্রেনটিতে ছিলেন। তখন তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, মন্দবাগ স্টেশনের এক নম্বর লাইনে প্রবেশ করে উদয়ন এক্সপ্রেস, একই লাইনে বিপরীত দিক থেকে তূর্ণা নিশীথা ট্রেনটি আসছিল।
ট্রেন দুটির এই স্টেশন অতিক্রম করার কথা ছিল। এই জন্য উদয়ন এক্সপ্রেসকে এক নম্বর লাইন থেকে ডান পাশের লুপ লাইনে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছিল, যাতে তূর্ণা নিশীথা পাশ কাটিয়ে স্টেশন পার হতে পারে। উদয়ন এক্সপ্রেস স্টেশনে প্রবেশের পর বিপরীত দিকের আউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে লালবাতি জ্বলে ওঠে। কিন্তু তূর্ণা ট্রেনটি লালবাতি উপেক্ষা করে স্টেশনের প্রবেশ মুখে চলে আসে। ততক্ষণে উদয়ন এক্সপ্রেসের ১৬টি বগির ৯টি লুপ লাইনে ঢুকে যায় কিন্তু বাকি সাতটি বগি তখনও মূল লাইনে ছিল। সে সময় ১০ নম্বর বগিতে আঘাত করে তূর্ণা নিশীথার লোকোমোটিভ। এতে উদয়ন এক্সপ্রেসের ১০ নম্বরসহ ১১ এবং ১২ নম্বর বগি লাইনচ্যুত হয়। ১০ নম্বর বগি দুমড়েমুচড়ে যায়।
২০১৮ সালে বড় দুর্ঘটনা : ২০১৮ সালের মার্চে চাঁদপুর রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছার পাঁচ মিনিট পূর্বে চাঁদপুরগামী মেঘনা এক্সপ্রেসের পাওয়ার কার ওভারহিটিং হয়ে আগুন ধরে যায়। পরিস্থিতি খারাপ দেখে প্রায় ৩০ জন যাত্রী আগুনে আতঙ্কে দ্রুত ট্রেন থেকে নামার সময় আহত হন।
একই বছরের ১৫ এপ্রিল গাজীপুরের টঙ্গী এলাকায় যাত্রীবাহী ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে পাঁচজন নিহত হন। কমিউটার ট্রেনটি জামালপুর থেকে ঢাকা যাচ্ছিল। টঙ্গী এসেই ঘটে যত বিপত্তি। ট্রেনের পাঁচটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে যায়। টঙ্গীর নতুনবাজার এলাকায় ঢাকা-জয়দেবপুর রেললাইনে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এতে আহত হয় প্রায় অর্ধশতাধিক। একই বছরে ঢাকা কমলাপুর ৮ নম্বর প্লাটফর্ম থেকে নারায়ণগঞ্জ গামী ট্রেন কমলাপুর স্টেশন থেকে ছেড়ে যাওয়ার সময় আইসিডির ভিতরে কন্টেইনারের সাথে দুর্ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় নিহত হন ছয়জন।
তাছাড়া ২০১০ সালে চট্টগ্রামগামী আন্তনগর ‘মহানগর গোধূলি’ ও ঢাকাগামী মেইল ‘চট্টলা’ ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে দুর্ঘটনা ঘটে। এতে দুটি ট্রেনের ইঞ্জিন দুমড়ে-মুচড়ে যায়। আর চট্টলা ট্রেনের একটি বগি মহানগর ট্রেনের ইঞ্জিনের ওপর উঠে যায়। সেই দুর্ঘটনায় চালকসহ মোট ১২ জন নিহত হন।
আগুন ধরে দুর্ঘটনা : ১৯৮৫ সালের ১৩ জানুয়ারি খুলনা থেকে পার্বতীপুরগামী সীমান্ত এক্সপ্রেসের কোচে আগুন ধরে যায়। এতে ২৭ জন যাত্রী নিহত হন এবং ২৭ জন আহত হন।
সর্বহারার নাশকতা : ১৯৮৬ সালের ১৫ মার্চ সর্বহারার নাশকতায় কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার কাছে ট্রেন লাইনচ্যুত হয় এবং নদীতে পড়ে যায়। এতে ২৫ জন যাত্রী নিহত হন এবং ৪৫ জন আহত হন।
হিলি ট্র্যাজেডি : ১৯৯৫ সালের ১৩ জানুয়ারি রাত সোয়া ৯টায় গোয়ালন্দ থেকে পার্বতীপুরগামী ৫১১ নম্বর লোকাল ট্রেনটি হিলি রেলস্টেশনের ১ নম্বর লাইনে এসে দাঁড়ায়। এর কিছুক্ষণ পর সৈয়দপুর থেকে খুলনাগামী ৭৪৮ নম্বর আন্তনগর সীমান্ত এক্সপ্রেস ট্রেনটি একই লাইনে ঢুকে পড়ে। এ সময় ভয়াবহ মুখোমুখি সংঘর্ষে গোয়ালন্দ লোকাল ট্রেনের ইঞ্জিনসহ দুটি বগি আন্তনগর ট্রেনের উপর উঠে যায়। এতে দুটি ট্রেনের অর্ধশতাধিক যাত্রী নিহত হয়। আহত হয় দুই শতাধিক।
সেতু ভেঙে দুর্ঘটনা : ১৯৮৩ সালের ২২ মার্চ ঈশ্বরদীর কাছে একটা রেল সেতু দিয়ে চলার সময় ভেঙে পড়ে। সাথে সাথে পরপর কয়েকটা স্পান ভেঙে পড়ে। কয়েকটি বগি নিচে শুকনা জায়গায় পড়ে। এ দুর্ঘটনায় ৬০ জন যাত্রী নিহত হন।
সামগ্রিকভাব রেলপথ গভীর সংকটে আছে বলে মনে করেন যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘এই ধরণের ঘটনা আরও বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে জরুরি মেরামত বাদ দিয়ে নতুন রেলপথ তৈরিতে আমরা ব্যস্ত হয়ে আছি। যেখানে লাখোকোটি টাকার প্রকল্প হচ্ছে। কিন্তু যে সমস্ত জরুরি মেরামত প্রয়োজন, যেখানে অল্প টাকা বিনিয়োগ করে রেল পথ ঝুঁকিমুক্ত করা যায় সেটা করা হচ্ছে না।’
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘অনভিজ্ঞ চালক ও সিগন্যালের ক্রুটির কারণে বেশির ভাগ দুর্ঘটনা ঘটেছে। রেল খাতে অভিজ্ঞ লোকোমাস্টারের সংকট রয়েছে। একজন সহকারী মাস্টারকে দীর্ঘদিন প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরে আন্তঃনগর ট্রেন পরিচালনা করানো যায়। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞ মাস্টার এলপিআরে (অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটি) চলে গেছেন।’
সূত্র : ঢাকা টাইমস
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।