স্পোর্টস ডেস্ক : ৩০৪- নিছকই সংখ্যা? নাহ, এটি একটা পোস্টাল কোড। যে কোডের পুরোটা ০৮৩০৪, কিন্তু এখন কোডের এই সংখ্যাগুলো যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ-যায়ই করুন না কেন, ফলাফল একই-লামিনে ইয়ামাল! একটি নতুন স্বপ্ন। পিছিয়ে থাকা মানুষের জন্য!
বিস্মিত হতেই পারেন। কিন্তু এও তো সত্যি, কখনও কখনও মানুষের নাম থাকে না; পরিচয়পত্র হয়ে ওঠে সংখ্যা, যেমন ক্রীতদাস, কিংবা কয়েদী নম্বর। কিংবা হরহামেশাই মানুষ যেমন নাক সিঁটকে বলে ‘অমুক অঞ্চলের লোক’, বিষয়টা যে তেমনি।
ইয়ামালও সেই গোত্রের, যাদের সে অর্থে নাম নেই কিংবা নামহীন; অঞ্চল দিয়ে চেনা হয় যাদের! এখন অবশ্য গল্পটা বদলেছে। বদলে দিয়েছেন এই তরুণ। যার উঠে আসা ইউরোপের দেশ স্পেনের হতদরিদ্র জনপদ রোকাফোন্দা থেকে, যেখানকার পোস্টাল কোড-৩০৪।
গোল করে আঙুলের ইশারায় এই সংখ্যাটিই ফুটিয়ে তুলছেন ইয়ামাল। বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছেন, কোথা থেকে উঠে এসেছেন তিনি। স্পেনের যে অঞ্চলে বেড়ে ওঠার পরিচয় দিতে মানুষ কুণ্ঠাবোধ করে, আড়ষ্ট থাকে। চলতি ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে স্পেনকে সামনে থেকে টেনে নিয়ে যাওয়া ইয়ামাল এই রোকাফোন্দারই ছেলে।
স্পেনকে নতুন করে স্বপ্নও দেখাচ্ছেন ইয়ামাল। সেটা কেবল ফুটবল নয়, সামাজিক, রাজনৈতিকসহ আরও নানা দিক থেকে। শ্রমিক শ্রেণীর, জাতিগত বৈচিত্রময়তার প্রতীক হয়ে ওঠা এই বিস্ময়বালক স্পেনকে গর্বিত করার পাশাপাশি দেখাচ্ছেন স্বপ্ন। যা একসময় মনে হতো অসম্ভব কিংবা কঠিন।
এই শনিবারে ১৭ বছর পূরণ হবে ইয়ামালের। যার জন্ম, বেড়ে ওঠা বার্সেলোনার মাতারোয়ের উপকূলীয় শহর রোকাফোন্দায়। যেখানে আজও তার বাবা মুনির নাসরাউই এবং দাদী বাস করেন। এখানকার আর সবার মতো নিজের ছেলের বেড়ে ওঠার গল্পটা মুনির এখন বলতে পারেন এক বুক গর্ব নিয়ে।
“আর সব ছেলেপেলের মতোই ইয়ামাল। সে একটা স্বপ্নের জন্য লড়াই করেছে এবং তা অর্জন করার সুযোগ পেয়েছে।”
স্থানীয় পানশালায় বসে মুনির যখন এই কথাগুলো বলছিলেন, স্পেন দলে ছেলের পরা জার্সি গায়ে জড়িয়ে, তখন মানুষ তার সঙ্গে সেলফি তুলেছে, আলিঙ্গন করেছে। আগামী রোববার ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ফাইনাল নিয়ে ভবিষ্যৎবাণীও করলেন তিনি-স্পেন জিতবে ৩-০ গোলে! এই সবকিছু কিছুদিন আগেও ছিল অভাবণীয়।
এল করদোবেস পানশালার দেয়ালে ঝুলছে ইয়ামালের স্বাক্ষরিত জার্সি। এই পানশালাটি মুনিরের পরিবারের অর্থনৈতিক সংগ্রামের সাক্ষীও। এই পানশালায় এলে ইয়ামালের বাবাকে বিনে পয়সায় কফি দেওয়া হতো, যাতে করে সেই পয়সা দিয়ে সে ছেলেকে ট্রেনে করে বার্সেলোনার একাডেমিতে অনুশীলনের জন্য নিয়ে যেতে পারে।
ইয়ামালের বাবাকে ফ্রি’তে কফি খাওয়ানো পানশালার মালিক হুয়ান কার্লোস সেরানোর এখন ভালোলাগার অন্ত নেই। বললেন, “ওহে, এই জার্সিটি আমাদের পাড়ার গর্ব!”
“লামিনে সেই ঘরানার ছেলে, যাদের কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে, যারা ভালো ছাত্র এবং সে সবেমাত্র মাধ্যমিক স্কুল পাস করেছে। এ কারণে সে শিশুদের জন্য দর্পণ।”
আসলেও তাই। মাতারোর এই অঞ্চলে সর্বনিম্ন আয়ের মানুষের বাস। এখানকার অধিকাংশ অধিবাসীদের জন্ম কাতালুনিয়া অঞ্চল এবং স্পেনের বাইরে। মূলত মরক্কোয়। ইয়ামালের জন্ম অবশ্য স্পেনে, কিন্তু তার বাবা মরক্কান এবং মা ইকুয়েটেরিয়াল গিনির। ছয় বছর বয়সে ইয়ামাল নাম লেখান বার্সেলোনার একাডেমিতে। ১১ বছর বয়সে ছেলে রোকাফোন্দা ছেড়ে বার্সেলোনায় চলে যান বলে জানালেন মুনির।
সেই ছেলেটিই গত মঙ্গলবার বিশ্বকাপ ও ইউরোর ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতা বনে গেছেন, ফ্রান্সের বিপক্ষে ২৫ গজ দূর থেকে চোখ ধাঁধানো শটে। রোকাফোন্দার আত্মবিশ্বাসও বাড়িয়ে দিয়েছে ওই গোল। কিভাবে? শুনুন ২৮ বছর বয়সী সুফিয়ানের কাছ থেকে, যার বাবা-মাও মরক্কান।
“মানুষ এখান থেকে উঠে আসার কথা বলতে লজ্জা পেত। এটা খুবই পিছিয়ে থাকা অঞ্চল, যেখানকার মানুষ মাসে এক হাজার ইউরো আয় করে। কিন্তু এখন, এমনকি যে লোকটি রোকাফোন্দা বা মাতারো’রও নয়, সেও বলছে: আমি ৩০৪ থেকে এসেছি!”
যে রুক্ষ মাঠে, রাস্তায় ইয়ামাল ফুটবল পায়ে মেতে থাকতেন, রোকাফোন্দার মরক্কান ও সেনেগাল বংশোদ্ভূত তরুণরা এখন সেই রাস্তায় হাঁটতে চাইছে ইয়ামালের পদাঙ্ক অনুসরণ করে। গল্পগুলো কিন্তু একই রকম, যেভাবে আর্জেন্টিনার লিওনেল মেসি, কিংবা ফ্রান্সের কিলিয়ান এমবাপের বেড়ে ওঠা।
ইয়ামাল আবার কৃষ্ণাঙ্গও। যেটি দেখাচ্ছে, সাম্প্রতিক সময়ে আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকা থেকে আসা অভিবাসীদের কারণে স্পেনের জাতিগত বৈচিত্রতা। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও ইয়ামাল প্রভাব রাখতে শুরু করেছেন। কেননা, অভিবাসীদের নিয়ে ইউরোপের দেশগুলোর নাক সিঁটকানো মনোভাব অপরিচিত নয় মোটেই।
স্পেনের ডান-পন্থী দল ভক্স, যারা শক্তভাবে অভিবাসী বিরোধী, তারা বৃহস্পতিবার ঘোষণা দিয়েছে, কেন্দ্রের পিপল’স পার্টির সাথে অনূর্ধ্ব-১৮ বছর বয়সী অভিবাসীদের আশ্রয় দেওয়ার নীতিতে মতবিরোধের কারণে পাঁচটি আঞ্চলিক সরকারের সাথে জোট ভেঙে দিবে। দিন বদলের সুর বাজছে এভাবেই।
সুফিয়ান তাই ইয়ামালের প্রভাব দেখছেন আরও বড় পরিসরে, “লামিনের মঙ্গলবারের গোলটি স্রেফ গোল ছিল না। এটা এই বার্তাও দিয়েছে- বর্ণবাদ শেষ এবং আমরা সবাই সমান।”
সমান সমান? সে বিতর্ক থাক। কিন্তু ইয়ামাল ঠিকই সবাইকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন, কৃষ্ণাঙ্গ কৃতদাসদের নিয়ে সাড়া জাগানো ‘জ্যাঙ্গো আনচেইনড’-সিনেমায় জিম কোরের গাওয়া সেই গানটি, ‘আই হ্যাভ গট এ নেম’। ৩০৪ সংখ্যা নয়, রোকাফোন্দার ছেলেটির নাম আছে- লামিনে ইয়ামাল।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।