ট্রাভেল ডেস্ক : লোকমুখে শুনেছি সুখী মানুষের দেশ ভুটান। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অনন্য এ ছোট্ট দেশ আমাদের শেখায় বেঁচে থাকার মানে। এখানে মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। সবাই পরিশ্রমী ও অতিথিপ্রিয়। দেশের রাজা থেকে সাধারণ মানুষ, সবার একটাই উদ্দেশ্য। তা হলো, আনন্দে থাকা-সুখে থাকা। ভুটানের অধিকাংশ শহরের নাম নদীর নামে।
অপরুপ সৌন্দর্য্যরে দেশ ভুটান। ছবির মতোই দেখতে পুরো দেশটা। যেদিকে তাকাবেন, জুড়িয়ে যাবে দু’চোখ। ক্লান্তি আসবে না একবারের জন্যও। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনুন্নত এ দেশটি ভারতীয় উপমহাদেশে হিমালয় পর্বতমালার পূর্বাংশে অবস্থিত। দেশটির নামের পেছনেও রয়েছে বেশ মজাদার একটি ইতিহাস। ‘ভুটান’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ ‘ভূ-উত্থান’ থেকে। যার অর্থ ‘উঁচু ভূমি’। পুরো দেশটিই উঁচু পাহাড়ের উপরের গড়ে উঠেছে। তাই এ নাম দেয়া হয়েছে বলে ইতিহাস থেকে জানাযায়। মাত্র সাড়ে সাত লাখ লোকের এ দেশটির প্রতিটি মানুষই বেশ কর্মঠ ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাদের মুখে সব সময়ই আপনি হাসি দেখতে পাবেন। তারা গরিব হলেও অতিথিদের সাথে (পর্যটক) কখনোই খারাপ আচরন তারা করেন না। পর্যটকদের ‘ভগবানের’ মতোই শ্রদ্ধা করেন ভুটানিরা। কারন পর্যটনই দেশটির মূল চালিকাশক্তি। যে কোন ছুটিতে ঘুরে আসতে পারেন ‘বজ্র ড্রাগন’ খ্যাত দেশটি থেকে। তবে আগস্ট থেকে অক্টোবর এই তিন মাস ভুটানে ঘুরবার উৎকৃষ্ট সময়। বর্ষাকালে ভুটানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় বলে বর্ষা মৌসুমে দেশটিতে বেড়ানো কঠিন।
সহজভাবে ভুটান যাওয়ার পথ
ঢাকা থেকে রওয়ানা হওয়ার আগেই আপনাকে ভারতীয় ট্রানজিট ভিসা নিতে হবে। ভিসা নেয়ার আগে ভিসা ফর্মের সাথে অবশ্যই শ্যামলী পরিবহনের রিটার্ন টিকিট জমা দিতে হবে আপনাকে। নয়তো ভিসা পাবেন না। ভিসা হয়ে গেলে আপনি শ্যামলী পরিবহনের টিকিট ফেরতও দিতে পারেন। কারন ওদের এসি বাসের অবস্থা খুবই বাজে। আপনি চাইলে কল্যানপুর থেকে এস আর, হানিফ, নাবিলসহ বিভিন্ন পরিবহনে করে ভুরিমারি সীমান্তে চলে আসবেন। বাস ভুরমারি সীমেন্ত পৌাঁবে সকাল সাড়ে ৬টায়। কিন্তু ইমিগ্রেশন খুলবে সকাল ৯টায়। এ সময়টা আপনি যে বাসে করে এসেছেন তাদের কাউন্টারে বিশ্রাম নেয়ার জন্য বেশ কয়েকটি কক্ষ আছে। ফ্রেসও হতে পারেন। ইমিগ্রেশন খোলার আগ পর্যন্ত নির্ভাবনায় আপনার লাগেজ কাউন্টারেই রাখতে পারবেন। হাতে যেহেতু সময় আছে তাই চাইলেই আপনি ভুরিমারি এলাকাটা ঘুরেও দেখতে পারেন।
ঢাকা থেকে রওয়ানা হওয়ার আগেই ট্রাভেল টেক্সের ৫০০ টাকা ব্যাংকে জমা দিয়ে যাবেন। ভুলে গেলেও সমস্যা নেই। কারন বাস কাউন্টারেই ট্রাভল টেক্সের টাকা জমা দিতে পারবেন। সেক্ষেত্রে আপনাকে গুনতে হবে অতিরিক্ত আরো তিনশত টাকা। আর এখানকার পরিবহন ব্যবসায়ীরা সবাই একটি সিন্ডিকেটের মতো করে রেখেছে। ইমিগ্রেশন অফিসের অসাধু কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে ভ্রমন পিপাষুদের ইমিগ্রেশনের নাম করে শ’দুয়েক টাকা হাতিয়ে নেয়। টাকা দিতে না চাইলে আপনার পাসপোর্ট জমা নেবে না ইমিগ্রেশন অফিসের কর্মকর্তারাই! সবার পেছনে ফেলে দেবে আপনাকে।
বাংলাদেশের সীমান্ত পাড় হয়ে ওপারে (চেংড়াবান্দা) যাওয়ার সাথে সাথে বাংলাদেশী দালালদের মতো ভারতীয় দালালরাও আপনার পাসপোর্ট জমা নিয়ে নেবে। তারা ইমিগ্রেশনের কাজটি দ্রুত করে দেবে, তবে সেক্ষেত্রে গুনতে হবে বাংলাদেশী একশ টাকা। এরপর সেখানেই আপনি চাইলে টাকা এক্সচেঞ্জ করতে পারবেন। ভুটানে ইন্ডিয়ান রুপি ওদের নিজস্ব মূদ্রার মতোই চলে, একই মান।
দুই ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করতে করতে আপনার প্রায় সাড়ে দশটা থেকে ১১টা বেজে যাবে। এবার আপনার মূল যাত্রা শুরু। ভারতীয় সীমান্ত থেকেই জীপ বা সমু (স্থানীয় ভাষায়) ভাড়া করে নিতে পারেন জয়গাঁ পর্যন্ত। ভাড়া পড়বে ১৫০০ থেকে ১৮০০ টাকা। দরদাম করে নিতে পারলে ভালো। আর একসাথে যদি আটজনের টিম হন, তাহলেতো কথাই নেই। আপনাদের খরচ একেবারেই কমে যাবে। সংখ্যায় কম হলেও সমস্যা নেই, কারন এই সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিনই প্রচুর পর্যটক আসা-যাওয়া করে।
রাতে বাসে ঘুমাতে না পারলেও জীপে বসে আপনার আর ঘুমানোর কোন সুযোগ থাকবে না। কারন রাস্তার দু’পাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আপনার দু’চোখের পাতাকে এক করতে দেবে না। কুচবিহার জেলা থেকে শুরু করে জয়গাঁ পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে দেখবেন চা বাগানের ছড়াছড়ি। পাহাড়ি এলাকা নয়, তারপরও সমতল ভূমিতে বেশ বড় বড় চা বাগান করে রেখেছেন ভারতীয়রা। চারদিকে ধান ক্ষেত তার পাশেই চা বাগান! শহরের বুক চিড়ে তৈরি করা হয়েছে চা বাগানগুলো। জয়গাঁ যাওয়ার পথেই ভুটানের সু-উচ্চ পাহাড়গুলো আপনার চোখে পড়বে। দূর থেকে দেখে মনে হবে আকাশ ভেদ করে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়গুলো। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে শুয়ে আছে সাদা মেঘের ভেলা। অসম্ভব সুন্দর এ দৃশ্য দেখে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারবেন না। ভুলে যাবেন দীর্ঘ ভ্রমন ক্লান্তি। ঘুম আসলেও দু’চোখের পাতা আপনি নিজেই বন্ধ হতে দেবেন না।
সকাল ১১টায় চেংড়াবান্দা থেকে যাত্রা শুরু করলে জয়গাঁ পৌঁছতে আপনার সময় লাগবে চার ঘন্টা। বিকাল ৩টা বাজে জয়গাঁ ইমিগ্রেশনে শুধু মাত্র নাম আর পাসপোর্ট নম্বর এন্ট্রি করে পাসপোর্টে এক্সিট সিল নিয়ে নেবেন। সেটা করতে বড়জোড় পাঁচ মিনিট। কাজ শেষ হলে ঐ জীপে করেই আপনাকে পৌঁছে দেয়া হবে ভুটান ইমিগ্রেশনে (ফুলসলিং সীমান্তে)। ভুটানে প্রবেশের জন্য ভারতীয়দের কোন ধরনের পার্মিশন প্রয়োজন হয়না। ওরা যখন-তখনই প্রবেশ করতে পারে। ভুটানিদের জন্যও আছে একই সুবিধা। তাই জীপের ড্রাইভার সোজা ইমিগ্রেশনের সামনে নামিয়ে দিয়ে আবার চলে যাবে ভারতে। এখানকার ইমিগ্রেশনের কর্মকর্তারা সবাই খুব হেল্পফুল। তারা নিজে থেকেই আপনার পাসপোর্টের ফরম ফিলাপ করার নিয়ম জানিয়ে দেবে। সু-শৃঙখলভাবে দ্রুততার সহিত ভুটানের অন অ্যারাইভেল ভিসা লাগিয়ে দেবে পাসপোর্টে। তবে সে জন্য পাসপোর্টের ফটোকপি ও এক কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি সাথে রাখবেন। ব্যাস আপনার কাজ শেষ। চলে গেলেন ভুটান। এবার সেখান থেকেই আপনার গন্তব্যস্থল রাজধানী থিম্পু অথবা পারোর জীপ নিতে পারেন। আছে টেক্সি ও পর্যটক বাসের সুবিধাও। তবে জীপ কিংবা টেক্সি নেয়াটাই বৃদ্ধিমানের কাজ। কারন যাত্রা পথে হাতের নাগালে থাকা মেঘের সাথে ছবি তুলতে মন চাইবে। তাই জীপ কিংবা টেক্সি থাকলে যখন-তখন থামাতে পারবেন।
ভুটানের পাহাড়ের পরতে পরতে রয়েছে সাদা মেঘের ভেলা। মেঘগুলো যেনো দল বেঁধে বসে থাকে পাহাড়ের ভাজে। আবার কিছু মেঘের খ- পাহাড়ের উঁচু স্থানে বাসা বেঁধে বসে থাকে। গাড়িতে বসেই আপনি দেখবেন মেঘের কতোটা কাছে আপনি। জীপ বা টেক্সিতে করে পাহাড়ের উঁচুতে উঠতে উঠতে একটা সময় দেখবেন মেঘ আপনার পায়ের নিচে। এমন দৃশ্য কেবল শিল্পির তুলেতেই সম্ভব ছিল। কিন্তু এখন আপনার চোখের সামনে। থিম্পু কিংবা পারো আসার পথ পুরোটাই পাহাড়ের বুক চিড়ে গড়ে উঠা। ১৯৬০ সালে ভারত সরকারের কাছ থেকে আর্থিক অনুদান নিয়ে পাহাড়ি রাস্তা নির্মান করেছিল ভুটানের তৎকালীন রাজা। ফুলসলিং থেকে থিম্পু শহরে আসতে আসতে রাত ৯টা বেজে যাবে। ও এর মধ্যে দু’বার পুলিশ চেকপোষ্টের মুখোমুখি হতে হবে আপনাকে। এটা আপনার নিরাপত্তার জন্যই করে থাকে ভুটান সরকার।
থিম্পুতে হোটেল ভাড়াও বেশ সস্তা। দু’জনের রুম (এসি) পাবেন এক হাজার রুপিতে। তবে একটু ভালো হোটেলে থাকতে হলে গুনতে হবে আরো পাঁচশত টাকা বেশী। আর সাবধান, ভুটানে ধুমপান নিষিদ্ধ। তাই ধুমপানের অভ্যাস থাকলে অবশ্যই হোটেল রুম অথবা পাহাড়ের আড়ালে গিয়ে পান করতে পারবেন। নয়তো আপনাকে গুনতে হবে জরিমানা।
লেখক : কবিরুল ইসলাম।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।