সাইফুল ইসলাম, মানিকগঞ্জ: মানিকগঞ্জে ভুল চিকিৎসায় রাণী বেগম (৬০) নামের এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। গত শুক্রবার লাইফ কেয়ার হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এ ঘটনা ঘটে। নিহত রাণী বেগম মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার মেঘশিমুল গ্রামের আক্কাস আলীর স্ত্রী।
ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে সালিসের মাধ্যমে মিমাংসা করা হয়েছে। গত শনিবার দুপুরে সাটুরিয়া উপজেলার জান্না বাজারে সালিসের সময় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে তিন লাখ টাকা জরিমানা করেন সালিসকারীরা।
রোগীর স্বজনদের সাথে কথা বলে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে থাইরয়েড রোগে ভুগছিলেন রাণী বেগম। ১৫ দিন আগে লাইফ কেয়ার হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চিকিৎসা নিতে গেলে চিকিৎসক তাকে অপারেশনের পরামর্শ দেন। কিন্তু তার শরীরে হরমোনের পরিমাণ বেশি থাকায় অপারেশন না করে স্বাভাবিক চিকিৎসা নিতে বলেন চিকিৎসক। গত বৃহস্পতিবার ফের হরমোন পরীক্ষা করলে ফলাফল স্বাভাবিক আসে। এরপর শুক্রবার তাকে অপারেশন করা হয়।
রাণী বেগমের ছেলে মো. সাগর মিয়া জানান, আমার মাকে শুক্রবার বেলা ১টা ৪৫ মিনিটে অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হয়। কিন্তু ভুল অপারেশনে আমার মায়ের অবস্থা খারাপ হলে বিকাল ৫টা ৫৫ মিনিটে ওটি থেকে বের করে সাভারের সুপার মেডিকেল হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। আমরা সুপারে পৌঁছালে চিকিৎসক আমার মাকে মৃত ঘোষণা করেন। তবুও নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমাদেরকে ইসিজি করার পরামর্শ দেন। ইসিজি করার পর মৃত্যু নিশ্চিত হন।
সাগার আরও জানান, ডাক্তার আরিফুর রহমান ও ডাক্তার সারোয়ার তার মায়ের অপারেশন করেন। এ সময় হাসপাতাল মালিক তোফাজ্জল হোসেনও সহযোগী হিসেবে চিকিৎসকদের সঙ্গে ছিলেন।
এদিকে, নিহত রাণী বেগমকে নিজের আত্মীয় পরিচয় দিয়ে সমঝোতার মাধ্যমে বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। গণমাধ্যমকর্মীদের কাছেও নানা রকম বিভ্রান্তিকর তথ্য দিতে থাকে। রোগীর চিকিৎসার ফাইল চাওয়া হলে হাসপাতালের মালিক তোফাজ্জল হোসেন জানান, চিকিৎসক ফাইল নিয়ে গেছেন। এরপর রাত সাড়ে ১১টার দিকে চিকিৎসকের সঙ্গে দেখা করে ফাইল নিয়ে আসেন।
তবে ফাইল নিয়ে যাওয়ার কথা অস্বীকার করেন ডাক্তার আরিফুর রহমান বলেন, আমি ফাইল নিয়ে আসিনি। রোগীর পোস্ট অপারেটিভ কনসিকুয়েন্স লিখে দিয়েছি। যেহেতু তারা ভালো লিখতে পারে না, কাজেই আমি লিখে দিয়েছি।
রোগী মারা যাওয়ার ৫/৬ ঘন্টা পর পোস্ট অপারেটিভ কনসিকুয়েন্স লেখার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। তবে পোস্ট অপারেটিভ কনসিকুয়েন্স লেখার কথা এনেসথেসিয়া চিকিৎসকের, সার্জনের নয়।
ভুল অপারেশনে মৃত্যুর বিষয়টি অস্বীকার করে হাসপাতাল মালিক তোফাজ্জল হোসেন বলেন, আমাদের হাসপাতালে অপারেশন করা হয়নি। এনেসথেসিয়া (অজ্ঞান) ইনজেকশন দেয়ার পর রোগীর অবস্থা খারাপ হলে আমরা সাভারের সুপার মেডিকেল হাসপাতালে রেফার্ড করি। সেখানেই রোগীর মৃত্যু হয়।
তবে রোগীর স্বজন ও চিকিৎসকরা জানিয়েছেন লাইফ কেয়ারেই অপারেশন করা হয়েছে। আর রোগীর সঙ্গে থাকা লাইফ কেয়ারের ওটি সহকারি মো. হাবিবুর রহমান জানান, নবীনগর পৌঁছানোর পর রোগী মারা যায়। লাশ গোসলের সঙ্গে থাকা নারীরা জানিয়েছেন, লাশের গলায় ৯টি সেলাই ছিল।
চিকিৎসক আরিফুর রহমান বলেন, বেলা ৪টা কিংবা সাড়ে ৪টার দিকে রোগীর স্কিন কাটার পর কালো রক্ত বের হতে থাকে। তখন আমি বুঝতে পারি যে, রোগীর অক্সিজেনেশন হচ্ছে না। বিষয়টি এনেসথেসিস্টকে বলি। সিনিয়র এনেসথেসিস্ট ডাক্তার শাহ আলমগীরকে ডাকি। তিনি এসে আমাকে অপারেশন বন্ধ রাখতে বলেন। এরপর রোগীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সুপারে রেফার্ড করি।
তিনি জানান, অক্সিজেন সরবরাহ কম হচ্ছিল। বিশেষ করে বাম পাশের ফুসফুস অক্সিজেন পাচ্ছিল না। কারণ টিউবটি ঠিক মতো সেটআপ করা হয়নি।
ডাক্তার শাহ আলমগীর জানান, রোগীর অবস্থা খারাপের কথা জানিয়ে সহযোগিতার জন্য ডাক্তার আরিফুর রহমান আমাকে ডাকেন। আমি গিয়ে দেখি অক্সিজেনেশন লেভেল ৯০। এরপর আমি সেটা ৯৭ করি। কিন্তু অক্সিজেন লেভেল উঠানামা করছিল। তখন আমি ডাক্তার আরিফুর রহমানকে অপারেশন বন্ধ রাখতে বলি। এই অপারেশনের সঙ্গে আমি কোনোভাবেই যুক্ত নই।
চিকিৎসকরা জানান, জেনারেল এনেসথেসিয়া (জিএ) অর্থাৎ পুরো শরীর অজ্ঞান করার আগে ব্লাড গ্রুপ, সিবিসি, আরবিএস, এইচবিএসএজি, বুকের এক্স-রে, ইসিজি, ইকো কার্ডিওগ্রাম ও ব্লাড প্রেসার পরীক্ষা করে নিতে হয়। ইসিজি ও ইকো কার্ডিওগ্রামে কোনো সমস্যা দেখা গেলে হার্ট কনসাল্টটেন্টের পরামর্শ নিতে হয়। কিন্তু রোগীকে এনেসথেসিয়া দেয়ার আগে শুধু ব্লাড গ্রুপ, এক্স-রে ও হরমোন পরীক্ষা করা হয়েছে।
নিহত রাণী বেগমের ছেলে সাগর মিয়া এই প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেছেন যে, অপারেশনের আগে তার মায়ের সিবিসি, আরবিএস, এইচবিএসএজি, ইসিজি ও ইকো কার্ডিয়াগ্রাম পরীক্ষা করা হয়নি। তবে সাভারের সুপার মেডিকেল হাসপাতালে নেয়ার পর মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার জন্য একটি ইসিজি করা হয়েছে। সেই ইসিজির রিপোর্ট এই প্রতিবেদককে সরবরাহ করেছে সাগর মিয়া।
ইসিজি, ইকো, আরবিএসসহ অনন্য পরীক্ষা ছাড়া রোগীকে অজ্ঞান করা হয়েছে কেন জানতে চাইলে এনেসথেসিয়া ডাক্তার সারোয়ার নানা রকম বিভ্রান্তিকর কথা বলেন। তিনি বলেন, ভাই আপনি একজন প্রফেশনাল মানুষ। আপনাকে মিথ্যা বলে লাভ হবে না। আপনি তো সব জেনেই গেছেন। আমার অফিসে চায়ের দাওয়াত রইলো।
এদিকে, রোগীর অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় সুপার মেডিকেল হাসপাতালে রেফার করা হলেও রোগীর কাগজপত্র রেখে দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। রোগীর ছেলে সাগর মিয়া, তার বন্ধু বাদল, হাসপাতালের ওটি সহকারি হাবিবুর রহমান ও রোগীর খালা মাজেদা বেগম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
হাবিবুর রহমান বলেন, আমাদের সঙ্গে কোনো কাগজপত্র ছিল না। আমরা শুধু রোগী নিয়ে গিয়েছি। ডাক্তার আরিফুর রহমান সুপারের ডাক্তারের সঙ্গে ফোনে কথা বলে সব বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাই কাগজপত্র নেয়ার প্রয়োজন পড়েনি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইএনও) বলেন, লাইফ কেয়ার নামে কোনো হাসপাতাল আছে কি’না সেটা আমার জানা নেই। আর ভুল চিকিৎসার বিষয়টি দেখবেন সিভিল সার্জন। আমার কাছে কেউ কোনো অভিযোগও করেনি। তবে হাসপাতালে কোনো অনিয়ম থাকলে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মানিকগঞ্জের সিভিল সার্জন (ভারপ্রাপ্ত) ডাক্তার লুৎফর রহমান বলেন, ঘটনাটা আমরা শুনেছি। লোক পাঠিয়েছিলাম, তথ্য সংগ্রহ করেছি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেব।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।