রফিক সরকার, গাজীপুর প্রতিনিধি: গাজীপুরের কালীগঞ্জে পর্যায়ক্রমে ভিক্ষুকদের ইন্টারভিউ নিচ্ছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. শিবলী সাদিক।
স্থানীয় ভিক্ষুকদের পুনর্বাসনকল্পে তিনি এই ব্যতিক্রমধর্মী এক উদ্যোগ নিয়েছেন। ইন্টারভিউ দিতে আসা ভিক্ষুকদের টিএ/ডিএ’রও ব্যাবস্থা করছেন। উপজেলাকে ভিক্ষুকমুক্ত করতেই তার এমন প্রয়াস।
জানা গেছে, এ উপজেলায় এরই মধ্যে ২১০জন ভিক্ষুক তালিকাভুক্ত হয়েছে। তাদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে কালীগঞ্জকে ভিক্ষুকমুক্ত করার প্রত্যয় নিয়ে ইউএনও তার অফিসে ইতোমধ্যে ২৯ জন ভিক্ষুক নারী-পুরুষের ইন্টারভিউ নিয়েছেন। আর এই কাজটিতে ইউএনওকে সহযোগীতা করছেন উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. শাহাদাৎ হোসেন, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আবু নাদির সিদ্দিকী, আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের উপজেলা কর্মকর্তা মো. মোস্তাফিজুর রহমান।
কেন? কি কারণে তারা ভিক্ষা করেন, কি করলে তারা ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে দিবেন? ভিক্ষুকদের এমন নানা সমস্যার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন ইউএনও মো. শিবলী সাদিক।
ইন্টারভিউ দাতাদের একজন উপজেলার জামালপুর ইউনিয়নের নারগানা গ্রামের ইয়াকুব আলী (৭৫) । তার দুই ছেলের এক ছেলে স্থানীয় একটি জুট মিলে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। অন্য ছেলে এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চালান। তারা বউ নিয়ে অন্যত্র থাকলেও বাবা-মাকে দেখভাল করেন না। বৃদ্ধ ইয়াকুব ভাঙ্গা একটি একচালা ঘরে বৃদ্ধা স্ত্রীকে নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। আর সে কারণে তিনি জীবন ও জীবিকার তাগিদে মানুষের দ্বারে দ্বারে হাতপাতা শুরু করেন। তবে কোনমতে চলার ব্যবস্থা থাকলে তিনি ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে দিবেন বলে জানালেন।
ওই গ্রামের আরেক ভিক্ষুক মো. ছাদেক আলী (৭৭) । তার এক ছেলে মানসিক সমস্যাগ্রস্থ। ভেবে ছিলেন ছেলেকে বিয়ে দিলে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তা আর হয়নি। বিয়ের কয়েক বছর যেতেই এক ছেলে জন্মের পর তাকে রেখে চলে যায় ছেলের বউ। জরাজীর্ণ একটি ঘরে স্ত্রী, মানসিক বিকারগ্রস্থ ছেলে ও নাতিকে নিয়ে চলছে মানবেতর জীবন। নিজের পৈত্রিক ভিটা ৫ শতাংশ জমির ওপর একটি ঘর ও একটি গরুর ব্যবস্থা হলে তিনি এই পেশাটি ছেড়ে দিবেন।
সাক্ষাৎকার নেওয়া হয় নারগানা গ্রামের ভিক্ষুক মো. মস্তফা মিয়ার (৮০) । দুই ছেলের একজন এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চালান। বিয়ে করে স্ত্রী নিয়ে তিনি এখন আলাদা। তবে বাবা-মায়ের কোন খোঁজ-খবর নেন না। অন্যজন একটি দূর্ঘটনায় পঙ্গু। তবে সেই ছেলেটির নগদ কিছু পুঁজি দিয়ে একটি ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করে দিলে হয়তো তার সংসারের অভাব কেটে যেতো। তাহলে তিনি ভিক্ষার পেশাটি ছেড়ে দিতে পারতেন।
জামালপুর গ্রামের গোলমহনের (৭০) উপযুক্ত চার ছেলে থাকার পরও ভিক্ষা করছেন। তিন ছেলে তাদের নিজেদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত মায়ের কোন দেখভাল করেন না তারা। এক ছেলে বাউল শিল্পী, গান বাজনা করে যা আয় করেন, তা দিয়ে স্ত্রী ও মাকে নিয়ে কোন রকম দিনাতিপাত করছেন। ছেলের বউই তাকে দেখভাল করেন। তাই ছেলের বউকে একটি কাজের ব্যবস্থা করে দিলে হয়তো তাকে আর ভিক্ষা করতে হতো না।
এছাড়া জামালপুর এলাকার ভিক্ষুক আকলিমা, নূরজাহান বেগম, হালিমা বেগম, শাহিদা বেগম, আমেনা বেগম, সামসুন নাহার, খোশেদা খাতুন, ফাতেমা বেগম কেউই অভিশপ্ত ভিক্ষাবৃত্তি করতে চাননা। অভাবের সংসার কিন্তু উপযুক্ত ছেলেরা ভরণ-পোষণ করেন না বিধায় ভিক্ষাবৃত্তিতে তারা জড়িয়ে পড়েছেন। বয়সের ভারে তারা ক্লান্ত, তারাও ভিক্ষাবৃত্তি করতে চান না। তাদের সংসার চলার মতো কোনো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে তাদের পুনর্বাসন করা হলে মানুষের কাছে আর হাত পাতবেন না। তবে তাদের চাওয়া তাদের কারো ছেলেকে চায়ের দোকান, কাউকে একটি রিকশা ও কাউকে কোনো কাজের ব্যবস্থা করে দিলে তারা ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে দিবেন। সাক্ষাতের সময় ইউএনও’র কাছে তারা এসব প্রতিশ্রুতি দেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, ‘এ উপজেলাকে ভিক্ষুকমুক্ত করার লক্ষ্যে তাদের সমস্যা সমাধানকল্পে সাক্ষাৎকার নেওয়া হচ্ছে। ভিক্ষুকদের পুনর্বাসন করতে সরকার সার্বিকভাবে সহযোগিতা করবেন। স্থানীয় কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হয়েছে, তারা আন্তরিক এ বিষয়ে। তারা সাহায্য-সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। তাই ভিক্ষুকদের ডেকে এনে তাদের সমস্যার কথা শুনে সমাধানের পথ খোঁজা হচ্ছে।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।