মো. রাকিবুল ইসলাম : জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিনিয়ত স্থানচ্যুতি এবং অভিবাসনের মূল নিয়ামক হয়ে উঠেছে। অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া না হলে বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও বহু মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাস্তুচ্যুত হয়ে অন্যত্র পাড়ি জমাতে বাধ্য হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
গত বছরের নভেম্বরে মিশরে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনের ২৭তম অধিবেশনে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) এবং ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম (সিভিএফ) যৌথভাবে জলবায়ু প্রভাবিত অভিবাসন এবং স্থানচ্যুতির বিষয়ে সদস্য দেশগুলোকে অধিকতর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল। কিন্তু এক বছর অতিক্রান্ত হতে চললেও বাংলাদেশে এর কোন ইতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়নি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের অনেক দেশেই ব্যাপক অভিবাসন সমস্যা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশে নিম্ন সমুদ্রপৃষ্ঠ, মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং অপর্যাপ্ত অবকাঠামো অভিবাসন সংকটকে বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।
প্রতিবছর দেশে বন্যা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে বহু মানুষ প্রাণ হারায়; নিম্নাঞ্চলগুলো বিপদসীমার উপর দিয়ে প্লাবিত হয়, খেত-খামারের ফসল, গবাদি পশু-পাখি হারিয়ে প্রান্তিক কৃষকরা নিঃস্ব হয়ে পড়েন। বন্যা, খরা, ঝড়-বৃষ্টি, নদীভাঙন এবং লবণাক্ততার উচ্চ সংবেদনশীলতার কারনে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূল অবস্থার দিক দিয়ে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। এর ফলে বহু মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। সহায় সম্বলহীন হয়ে জীবিকার সন্ধানে অন্যত্র পাড়ি জমাতে বাধ্য হচ্ছে। বিশেষ করে শহরমুখী হচ্ছে অধিকাংশ বাস্তুচ্যুত মানুষ। ছোট শহরগুলোতে পর্যাপ্ত কাজের ব্যবস্থা না থাকায় বিভাগীয় শহরগুলোতে, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় গৃহহীন মানুষের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এই অত্যাধিক মানুষের চাপে ঢাকা চরম পরিবেশ বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে।
এতে একদিকে পুরাতন বাসিন্দাদের স্বাস্থ্য ঝুকি বাড়ছে, অন্যদিকে নতুন অভিবাসীরা চরম ঝুকির মধ্যে পড়ছে। অভ্যন্তরীণ স্থানচ্যুতি বিষয়ক বৈশ্বিক প্রতিবেদন ২০২১ অনুসারে, ২০৫০ সালের মধ্যে সারা বিশ্বে আনুমানিক ২১৬ মিলিয়ন মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অভ্যন্তরীণ অভিবাসী হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সরকারের হিসেব অনুযায়ী, আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে প্রতি ৭ জন বাংলাদেশির একজন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুত হবে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা বর্তমানে বার্ষিক প্রায় ১ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে ২০২১ থেকে ২০২২ সাল, এক বছরের ব্যবধানে ঢাকার জনসংখ্যা বেড়েছে ৩ শতাংশ। প্রতিদিনই বেড়ে চলেছে এ শহরের জনসংখ্যা।
দেশে গত ৫০ বছরে ১ কোটিরও বেশি মানুষ বিরূপ জলবায়ুর কারনে উদ্বাস্তু হয়ে পড়েছে। এর আধিকাংশই উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিজেদের ঘরবাড়ি হারিয়ে অন্য অঞ্চলে অভিবাসন খুঁজতে বাধ্য হয়েছে তারা। মাইগ্রেশন কাউন্সিলের তথ্য অনুসারে, বর্তমানে প্রতিদিন আনুমানিক ২ হাজার মানুষ ঢাকায় পাড়ি জমাচ্ছে জীবিকার প্রয়োজনে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই প্রবণতা এতটাই অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে যে, ২০১১ সালে ঢাকাকে দুটি অঞ্চলে (উত্তর ও দক্ষিণ ঢাকা) ভাগ করতে বাধ্য হয় সরকার। কারণ এতসংখ্যক মানুষের জন্য সামাজিক সেবা নিশ্চিত করা দুরূহ হয়ে পড়ছিল সরকারের পক্ষে।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিবাসনের মাত্রা সবচেয়ে বেশি হবে। ধাপে ধাপে বাংলাদেশের অনেক মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। বাংলাদেশের ভেতরে সবচেয়ে বেশি চাপ পড়বে খুলনা শহরে। এরপরেই ঢাকা ও চট্টগ্রামে চাপ বাড়বে। জলবায়ুর পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ তাদের বসতি ছেড়ে ওই তিন বিভাগীয় শহরে আশ্রয়ের খোঁজে আসবে। প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এ শতকের শেষ নাগাদ সমুদ্রের পানির উচ্চতা ৪০ সেন্টিমিটার বাড়বে। আর যেভাবে সবকিছু চলছে সেভাবে যদি চলে, তাহলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়বে ৮৪ সেন্টিমিটার।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বন্যা, খরা, মাটি ও পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও নদীভাঙনের মতো দুর্যোগের মাত্রা বাড়বে। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলকে খরাপ্রবণ, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে লবণাক্ততা-প্রবণ ও দক্ষিণাঞ্চলকে নদীভাঙন-প্রবণ এলাকা হিসেবে এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, এসব উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মানুষেরা তাদের নিকটস্থ বিভাগীয় শহরগুলোতে আবাস গড়বে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ খুলনাকে, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের মানুষ চট্টগ্রামকে আর মধ্যাঞ্চলের মানুষ ঢাকাকে তাদের নতুন আবাসস্থল হিসেবে বেছে নেবে। এ ছাড়া পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত ও মিয়ানমারেও কিছু অভিবাসন ঘটবে।
বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে এখন প্রতিবছর চার লাখ মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসছেন স্থায়ীভাবে। এই সংখ্যা প্রতিদিন দুই হাজারের মতো। তাদের মধ্যে শতকরা ৭০ ভাগ জলবায়ু উদ্বাস্তু।
বাংলাদেশের দক্ষিণের জেলা বাগেরহাটের মোংলা উপজেলার বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা)আহ্বায়ক নুর আলম শেখ বলেন, লবনাক্ততা বাড়ছে, বাড়ছে নদী ভাঙন- যা প্রাণ ও প্রকৃতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। কৃষি নির্ভর এলাকার মানুষ কাজ হারিয়ে শহরে যাচ্ছেন কাজের খোঁজে। কেউ একাই যাচ্ছেন, আবার কেউ সপরিবারে। তারা শুধু ঢাকা নয় অন্য শহরেও যাচ্ছেন কাজের খোঁজে।
তিনি আরও বলেন, শুধু গরিব মানুষ নন, ধনীরাও জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হচ্ছেন। খাবার পানির সংকট সবাইকে বিপর্যস্ত করছে। লবণ পানির কারণে এই এলাকায় প্রতি তিনজনে একজন উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন ৷ জলবায়ু উদ্বাস্তু হয়ে মানুষ এলাকা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন।
এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ ভবিষ্যৎ তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখার জন্য প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা রয়েছে। এটি পূরণের জন্য শক্তিশালী বৈশ্বিক পদক্ষেপের প্রয়োজন। সেই সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং জাতীয় নীতিগুলিতে জলবায়ু অভিবাসন বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার। বিশেষ করে বাংলাদেশে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণপূর্বক এর বাস্তবায়ন জরুরী। তা-না হলে বাংলাদেশকে এর জন্য চরম মাশুল গুনতে হবে বলে আশংকা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।